
অনলাইন ডেস্কঃ
‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’ প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার লুটপাট হয়েছে! প্রকল্পের অধীনে ১৩টি গবেষণার বিষয় রয়েছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের সম্পৃক্ততায় এ প্রকল্পে গবেষণার নামে কপি-পেস্ট, মাঠপর্যায়ের কাজের অনুপস্থিতি এবং জবাবদিহিহীনতা উঠে এসেছে খোদ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) তদন্তে। গবেষণাপত্রে নিজেদের আগের লেখা পুনর্ব্যবহার, অদৃশ্য বই বিতরণ, সীমিত সংখ্যক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পরও বিশাল ব্যয়ের হিসাব — সব মিলিয়ে ‘চেতনার দোকান’ এখন রীতিমতো লুটের মাঠে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন’-নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। এতে ব্যয় ধরা হয় ২৩ কোটি ৫২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে জুনে। ইতোমধ্যে কাজের ৮০ ভাগ সম্পন্ন দেখিয়ে সবমিলিয়ে ১৩ কোটি ২৫ লাখ ৭ হাজার ৪৫০ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এলে প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত রেখে তদন্ত করতে দেওয়া হয়।
এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। ৮ সদস্যের কমিটির আহ্বায়ক করা হয় হাবিবুল আলম বীরপ্রতীককে। সদস্যরা হলেন-জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মেজর (অব.) কাইয়ুম খান, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান, আলী আহমেদ জিয়া উদ্দিন, বীরপ্রতীক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক কায়সার হামিদুল হক, বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, সদস্য সচিব জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন। এই কমিটি ১৩ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক বলেন, কাজ না করে হরিলুট করতেই এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের সঙ্গে কাজের কোনো মিল নেই। কোনো কাজও হয়নি। যেনতেন গবেষণা আর দলীয় প্রভাবে টাকাও তুলে নেওয়া হয়েছে। আমরা তদন্ত দিয়েছিলাম। প্রতিবেদনও পেয়েছি। সেখানে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ওঠে এসেছে। এ নিয়ে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শনিবার বলেন, প্রকল্পের নামে সারা বাংলাদেশে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, দলীয়করণ হয়েছে এটি তারই অংশ। তদন্ত প্রতিবেদনে সত্যতা নিশ্চিত হলে জড়িতদের শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে।
প্রকল্প পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ১৩ মার্চ বৈঠক করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। প্রকল্পের আওতায় গৃহীত ১৩টি গবেষণা প্রতিবেদন যে পর্যায়ে আছে সে পর্যায়ে রেখে প্রকল্পটি বাতিল ও আর কোনো অর্থ ব্যয় না করা এবং প্রকল্পের আওতায় ক্রয়কৃত মালামাল, অফিস সরঞ্জামাদি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নিকট হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরে এই সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়কে লিখিত ভাবে জানিয়ে দেয় জামুকা।
তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের অধীনে ১৩টি গবেষণার বিষয় রয়েছে: এগুলো হলো-১. ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু; ২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট ও বঙ্গবন্ধু; ৩. মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নির্মাণে ৬২র শিক্ষা আন্দোলন; ৪. বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচির ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব; ৫. ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান : তাৎপর্য ও ভূমিকা; ৬. বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্র গঠনে ১৯৭০ সালের নির্বাচন; ৭. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী; ৮. মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধীদের ভূমিকা; ৯. রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ১৯৭১-৭৫; ১০. মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা; ১১. ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী; ১২. মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা; এবং ১৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহির্বিশ্বের ভূমিকা।
তদন্ত কমিটির সংশ্লিষ্টরা জানান, মাঠপর্যায়ের এসব কাজের অধিকাংশের হদিস পাওয়া না গেলেও এই প্রকল্পে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংবলিত ৬৪ হাজার ৬৪৫টি বই বিতরণ করার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের স্থানীয় পর্যায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধকালীন বীরত্বগাথা শোনানোর জন্য ১৪৮টি অনুষ্ঠানের মধ্যে ১০০টি সম্পন্ন করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ১৩টি মৌলিক গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি ও জমা দেওয়া হয়েছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে ব্যাপক অনিয়মের কথা উল্লেখ করে বলা হয়-গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ও নতুন কিছু উদ্ভাবন করা এ গবেষণা প্রতিবেদনে পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ তথ্যই কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এতে গবেষকরা নিজেদের ইতঃপূর্বে প্রকাশিত তথ্য ও লেখা অধিকমাত্রায় পুনরায় প্রতিস্থাপন করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনে ইতিহাসের অনেক সত্যকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ গবেষণা প্রতিবেদনে শুধু ব্যক্তি ও সুনির্দিষ্ট একটি দলকে গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয়েছে যা গবেষণার মান ও গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনগুলো ফরমায়েশি বাক্যের সংকলন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই এই প্রকল্পে। যেসব প্রতিষ্ঠান এ গবেষণা পরিচালনা করেছে তাদের যোগ্যতা/গ্রহণযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।
পর্যালোচনা কমিটি সিদ্ধান্ত আকারে পাঁচটি সুপারিশ করেছে। এগুলো হচ্ছে-১. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প বাতিল, ২. মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বাজেটের আওতায় গৃহীত আলোচ্য ৩টি গবেষণা কার্যক্রম বাতিল, ৩. কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে আর কোনো অর্থ পরিশোধ না করা, ৪. যেসব গবেষণা প্রতিবেদন জমা হয়েছে, সেগুলো যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায় অফিসে সংরক্ষণ করা এবং ৫. প্রকল্পের যাবতীয় বিষয়াদি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে বুঝিয়ে দেওয়া।
এসব সুপারিশের আলোকে প্রকল্পের কার্যক্রম অসমাপ্ত রেখে প্রকল্প বাতিল করতে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য: মন্তব্য নিতে উল্লিখিত সাত বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য নিতে শুক্রবার ও শনিবার তাদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। অধিকাংশের ফোন ছিল বন্ধ। তবে কয়েকজনকে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একজন নাম প্রকাশ না করে বক্তব্য দিয়েছেন। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কালেকটিভ (আরডিসি) প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল জানান, গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে পর্যালোচনা কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে তা একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য। রাজনীতিকরণের ট্যাগ দিয়ে প্রভাবিত করার রিপোর্ট। অন্যদের গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে কিছু বলব না। তবে আমরা এসব প্রতিবেদন করতে অনেক পরিশ্রম করেছি। ১৬টি জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রতিবেদন তৈরি করেছি। ইংল্যান্ড, রাশিয়া পর্যন্ত যোগাযোগ করতে হয়েছে। আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতেই এমন নেতিবাচক তদন্ত প্রতিবেদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অধ্যাপক ড. মো. এমরান জাহান বলেন, আমার গবেষণার বিষয় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী। এখানে ব্যক্তির প্রশংসার স্থান নেই। আমি সারা দেশ ঘুরে যুদ্ধকালীন সময়ের নারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। ৬০০ পৃষ্ঠায় গবেষণাপত্র জমা দিয়েছি। এটির রিভিউ করে সংশোধন করা হয়েছে। পটপরিবর্তনের পর সরকার চাইলে আবারও রিভিউ করতে পারত। কোথায় সমস্যা বললে আমরা সংশোধন করে দিতাম। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়ে আমার নিরপেক্ষতার আলোকে করা গবেষণাপত্রটি অন্যান্যদের সঙ্গে স্থগিত করে দিল। আমাকে জানতেই দিল না কোথায় ত্রুটি আছে। এই কাজে আমি ২ লাখ টাকা ঋণে আছি।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, আমরা প্রতিষ্ঠানের মালিক। গবেষণাপত্রের জন্য সরকার যে অর্থ প্রদান করেছে তা প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছি। সরকার স্বচ্ছতা যাচাই করে টেন্ডারের মাধ্যমে আমাকে গবেষণা কাজ দিয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানও সরকারের সব নিয়ম মেনেই গবেষণাপত্র জমা দিয়েছে। এখন নতুন সরকার, তাই আগের সরকারের সব প্রকল্পে ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রুটি বের করার চেষ্টা করছে।
সূত্রঃ যুগান্তর