
অনলাইন ডেস্কঃ
বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি না রেখেই ‘অবাস্তবিক’ভাবে তৈরি করা হয়েছে প্রকল্পের নকশা। অর্থাৎ সারা দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর বিপরীতে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মাত্র ৫০ হাজারের। এছাড়া প্রকল্পটি সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক হলেও বাস্তবে তা হয়নি। মেয়াদ ফুরিয়ে এলেও অন্যতম কাজ বিধিমালাই এখনো সংশোধন হয়নি। এছাড়া রয়েছে আরও নানা অহেতুক খরচও। ফলে শেষ পর্যন্ত ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক’ প্রকল্পের ৫৪ কোটি টাকার পুরোটাই অপচয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনের দ্বিতীয় খসড়ায় উঠে এসেছে এসব তথ্য। জুনে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হবে। পরিবশে, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের আওতায় এটি বাস্তবায়ন করছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
আইএমইডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, প্রকল্পে ব্যাপক নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে। কেননা এতে কার্যকর কোনো ফল আসবে না জেনেও পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাতে নেওয়া হয়েছিল। এতে যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, অধিকাংশের সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করা হয়নি।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, এ ধরনের প্রকল্প নিঃসন্দেহে লুটপাটের উদ্দেশ্যেই হাতে নেওয়া হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এডিপিতে এ ধরনের প্রকল্প আছে। সেগুলোও খুঁজে বের করা উচিত। এক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনের যারা জড়িত ছিল, সবাই দায়ী। এমন প্রকল্প নেওয়াটাই একটা বড় অপরাধ। সুতরাং অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটি ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৪৭ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। পরে প্রথম সংশোধনীতে না বাড়লেও দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে ব্যয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এছাড়া মূল অনুমোদিত মেয়াদের তুলনায় সময় বেড়েছে ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ মূল মেয়াদ ছিল ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। শুরু থেকে গত মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৩৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। প্রতিবেদনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ সংশোধন করে সময়োপযোগী করে তৈরির কাজ নির্ধারিত থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। ফলে প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে মাত্র দেড় হাজার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিমাসে মাত্র ২৫টি করে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছিল, যা সার্বিক বিবেচনায় খুবই নগণ্য। প্রকল্পের নাম সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক বলা হলেও এ প্রকল্পর মাধ্যমে পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বিআরটিএ এবং সিভিল সার্জনের অফিস থেকে প্রশিক্ষক আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে আর অন্য কোনো সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়নি। কিন্তু যেহেতু এটি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, তাই অধিক সংখ্যক সংস্থার অংশগ্রহণ এবং অধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা জরুরি ছিল। এদিকে সারা দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে শব্দদূষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রাক্কলন করা হয়। বাস্তবতা বিবেচনায় এ প্রশিক্ষণ কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। এক্ষেত্রে বরং ৫০ হাজার শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত এবং প্রতিটি স্কুলে একটি করে পরিবেশবিষয়ক ক্লাব স্থাপন করলে বশি কার্যকরী হতো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শব্দদূষণ সচেতনতার জন্য সারা দেশে যেসব বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল, সেগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। অধিকাংশ জেলায় এসব বিলবোর্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার কোথাও আইএমইডির পদির্শনের কথা শুনে নতুন করে বিলবোর্ড টানানো হয়েছে। এছাড়া শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে লাখ লাখ লিফলেট বিতরণ, স্টিকার ছাপিয়ে যে অর্থ খরচ করা হয়েছে তার চেয়ে কম অর্থ ব্যবহার করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করলে অধিক সুফল পাওয়া যেত।
প্রকল্পে এখন পর্যন্ত চারজন পরিচালক অতিরিক্ত হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন ও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ায় প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক ও ব্যক্তি পরামর্শক ছাড়া এটি বাস্তবায়নে অন্য কোনো জনবল নেই। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাত্র ৮টি এবং স্টিয়ারিং কমিটির মাত্র ১২টি সভা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সুপারিশে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের বিধিমালা সংশোধন করে সময়োপযোগী করতে হবে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকার শব্দদূষণের মাত্রা ও উৎসস্থলে অধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। শব্দ সচেতনতামূলক বার্তাসহ কাঠের কলমদানি, পেপার ওয়েট, ক্যাপ, ক্যালেন্ডারসহ এ ধরনের খাতে প্রকল্প থেকে ব্যয় বন্ধ করতে হবে। ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীদের নাম, প্রতিষ্ঠান, মোবাইল নম্বরসহ উপস্থিতির তালিকা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে সমন্বিত ও অংশীদারত্বমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
সূত্রঃ যুগান্তর