
অনলাইন ডেস্কঃ
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় বিএনপির অঙ্গসংগঠন শ্রমিক দল, যুবদল ও ছাত্রদলের কর্মীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন ওই নারীর স্বামী।
সোমবার সাতজনের নাম উল্লেখ করে এই মামলা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ভোলা জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শরীফুল হক।
ওই গৃহবধূর স্বামী তজুমদ্দিন উপজেলার একটি ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিনি ঢাকার একটি হোটেলে বাবুর্চির চাকরি করতেন। তার দুইজন স্ত্রী রয়েছে বলেও তিনি জানান।
তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, শনিবার রাতে দ্বিতীয় স্ত্রীর ডাকে তার বাসায় যান। সেখানে গেলে উপজেলা শ্রমিক দল ও যুবদলের কয়েকজন তাকে আটকে রেখে টাকার দাবিতে রাতভর নির্যাতন চালান। পরে ফোন করে তার প্রথম স্ত্রীকে টাকা নিয়ে স্বামীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে বলা হয়।
রোববার সকালে প্রথম স্ত্রী ঘটনাস্থলে (দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসা) গেলে তার কাছে চার লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় ওই ব্যক্তিকে পাইপ ও রড দিয়ে বেদম মারধর করা হয়। এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে তাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে তার প্রথম স্ত্রীকে কয়েকজন ‘ধর্ষণ’ করে।
“শ্রমিক দল, যুবদল, ছাত্রদলের এরা সারা রাত আমারে মারধর করে। সকালে বড় বউ আমাকে ছাড়ায়ে নিতে আসার পর ওরা আমারে বাইরে সরিয়ে নিয়ে আমার প্রথম বউরে সবাই মিলে ধর্ষণ করছে,” অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি নিজেও বিএনপির একজন কর্মী বলে দাবি করেছেন বিবিসি বাংলার কাছে।
সোমবার তজুমদ্দিন থানায় মামলার পর রাতে ভোলা সদর হাসপাতালে ওই নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক শেখ সুফিয়ান রুস্তম।
এদিকে, ধর্ষণে অভিযুক্ত উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ফরিদ উদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা মিন্টু।
তিনি জানিয়েছেন, এই ঘটনায় আরও যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে দল।
এই ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে তজুমদ্দিন ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের দুই নেতাকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল।
কী ঘটেছিল?
মামলার বাদী বিবিসি বাংলাকে জানান, সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি ঢাকা থেকে এলাকায় আসেন প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে। গত শনিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ফোন করে তাকে তজুমদ্দিনে তার বাসায় যেতে বলেন।
তিনি জানান, রাতের বেলায় তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসায় যাওয়ার পর সেখানে পাঁচ-ছয় জনের একটি দল ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ফরিদ উদ্দিন, যুবদল কর্মী আলাউদ্দিনকে তিনি আগে থেকে চিনতেন বলে দাবি করেন।
“ওরা ঘরে ঢুকেই আমারে পাইপ দিয়ে পিটাইতে থাকে ও আমার কাছে চার লাখ টাকা চায়। আমাকে মারধর করা অবস্থায় আমার বড় বউকে ফোন দিয়ে আমার চিৎকার শোনায়। পরে আমার বড় বউ টাকা নিয়ে আসবে জানানোর পর ওরা আমারে পিটানো বন্ধ করে”, বলেন ভুক্তভোগী নারীর স্বামী।
অভিযুক্তরা তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথায় জোর করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে বলেও তিনি দাবি করেন।
তিনি বলেন, “সকালে আমার বউ আসার পর তাকে ফরিদ-আলাউদ্দিনরা জিজ্ঞাসা করে যে সে টাকা আনছে কি-না। যখন আমার বউ (বড়) বলছে যে তার কাছে টাকা নাই, তখন আবার আমারে ওরা মারতে শুরু করে।”
তিনি দাবি করেন, এক পর্যায়ে তার প্রথম স্ত্রী তার শ্বশুরকে ফোন দিয়ে টাকা ম্যানেজ করতে বলেন। টাকা আনার কথা শোনার পর রোববার দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তিনজনের একটি দল তাকে ওষুধ ও চা খাওয়ানোর কথা বলে তাকে বাইরে নিয়ে যায় বলে তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান।
ওই ব্যক্তির অভিযোগ, তিনি যখন বাইরে চা খেতে যান তখন অভিযুক্ত ফরিদ, আলাউদ্দিন ছাড়াও আরও অন্তত দুইজন ওই বাসার ভেতরেই ছিলেন। চা খাওয়ানোর কথা বলে তাকে তিনজন একটি দোকানে ঘণ্টাখানেক ধরে আটকে রাখে বলেও দাবি করেন তিনি।
ওই ব্যক্তি জানান, ঘণ্টাখানেক পর তিনি যখন ফিরে আসেন তখন তিনি দেখতে পান ওই বাসার গেট ভেতর থেকে আটকানো। পরে ধাক্কাধাক্কির পর ওরা দরজা খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে আসে।
“আমারে যখন চা- রুটি খাওয়াইতে নিয়ে গেছে সেই সুযোগে ওরা আমার বড় বউয়ের লগে এই কাজটি (ধর্ষণ) করছে। সে সময় আমার ছোট বউ ওই বাসাতেই ছিল, তার সামনেই এসব করছে,” কান্নারত অবস্থায় বিবিসিকে বলছিলেন ওই ব্যক্তি।
থানায় মামলা দায়েরের পর স্থানীয় গণমাধ্যমে ঘটনাটি নিয়ে অভিযোগকারী নারী সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। সেখানে তিনিও তাকে ‘সংঘবদ্ধ ধর্ষণের’ অভিযোগ করেছেন।
থানায় মামলা, একজন গ্রেফতার
বিবিসি বাংলাকে মামলার বাদী আরও জানান, যখন তাদের ঘটনাস্থল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় তখন প্রায় সন্ধ্যা। তার প্রথম স্ত্রী তখন অপমান ও লজ্জায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
ভোলার তজুমদ্দিনের স্থানীয় সাংবাদিক গণমাধ্যমকর্মী সাদির হোসেন রাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রোববার সন্ধ্যায় স্থানীয় ওই বাজারে হঠাৎ একসাথে অনেক মানুষের জড়ো হওয়া দেখে সেখানে ছুটে গিয়ে জানতে পারি একজন নারী ধর্ষণের স্বীকার হয়ে দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। সেই নারীকে তার স্বামীসহ স্থানীয় কয়েকজন এখানে নিয়ে এসেছে।”
সেই দম্পতির কাছ থেকে পুরো ঘটনার বর্ণনা শুনে স্থানীয় সাংবাদিকরা তাদের আইনি সহায়তা নেয়ার জন্য পরামর্শ দেন।
মি. সাদির বলেন, “এক পর্যায়ে তারা আমাদের পরামর্শে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ এ ফোন দিয়ে পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মামলা করতে ও তাদের নিরাপত্তা দিয়ে থানায় নিয়ে যেতে পুলিশের সহযোগিতা চায়। পরবর্তীতে দুইজন পুরুষ পুলিশ এসে একটি অটো রিকশায় করে তাদের থানায় নিয়ে যায়।”
থানায় গিয়ে ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামী অভিযুক্ত আলাউদ্দিন, মো. ফরিদ, তার দ্বিতীয় স্ত্রীসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও চার/পাঁচজনের নামে তজুমদ্দিন থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।
মামলার পর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাব্বত খানকে।
ভোলা জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শরীফুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “অভিযোগটি প্রাথমিকভাবে সত্য ধরে নিয়েই কাজ করছি আমরা। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যারা অভিযুক্ত রয়েছে তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।”
তিনি জানান, থানায় মামলার পরই মামলার তিন নম্বর আসামিকে (অভিযোগকারীর দ্বিতীয় স্ত্রী) আটক করার পর মঙ্গলবার আদালতে পাঠানো হয়।
পুলিশ সুপার মি. হক বলেন, “এজহারের নামীয় আসামি সাতজন। এরমধ্যে আলোচিত দুইজনসহ অন্য আসামিদের ধরার জোর চেষ্টা চলছে। যখনই মামলা হয়েছে তারপরই তারা আত্মগোপনে চলে গেছে। আমরা গ্রেফতারের জোর চেষ্টা চালাচ্ছি।”
শ্রমিক দল ও ছাত্রদলের তিন জন বহিষ্কার
নিজেকে বিএনপির কর্মী দাবি করে মামলার বাদী বলছেন, তাকে যারা মারধর করেছে এবং তার স্ত্রীকে সংঘবদ্ধভাবে ‘ধর্ষণ’ করেছে তারাও বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের রাজনীতির সাথে জড়িত।
মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, স্থানীয় গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক দল, যুবদল ও ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে জড়িত।
অভিযোগকারীর বর্ণনা অনুযায়ী, পুরো ঘটনাটি ঘটেছে তজুমদ্দিন উপজেলা শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ফরিদ উদ্দিনের নেতৃত্বে।
মঙ্গলবার বিকেলে ভোলা জেলা পুলিশ সুপারের কাছ থেকে মামলার এজাহার সংগ্রহ করেছে বিবিসি বাংলা।
এতে দেখা গেছে মামলার দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে শ্রমিক দল নেতা ফরিদ উদ্দিনকে। আর এক নম্বর আসামি করা হয়েছে মো. আলাউদ্দিনকে।
মো. আলাউদ্দিন স্থানীয়ভাবে যুবদলের রাজনীতির সাথে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন।
এই নিয়ে বিবিসি বাংলা কথা বলে তজুমদ্দিন থানা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোস্তফা মিন্টুর সাথে।
মি. মিন্টু বিবিসি বাংলাকে জানান, অভিযুক্ত শ্রমিক দল নেতা ও মামলার আসামি মো. ফরিদ উদ্দিনকে আজীবনের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “ফরিদ উদ্দিন, আলাউদ্দিনসহ যারাই জড়িত আছে তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে দল। আমি কথা দিতে পারি তাদের পাশে দাঁড়াবে না বিএনপি।”
এদিকে, মঙ্গলবার রাতে ছাত্রদলের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ভোলা জেলা শাখার অধীন তজুমদ্দিন ডিগ্রি কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো. রাসেল এবং যুগ্ম আহ্বায়ক মো. জয়নাল আবেদীন সজীবকে সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক (সহ-সভাপতি পদমর্যাদা) মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
তবে মো. রাসেল ওই মামলার সাত নম্বর আসামি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিবিসি বাংলাকে জানান, “ভোলার ওই ঘটনায় প্রাথমিক অভিযোগ ওঠায় এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়েছি এবং পুলিশকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছি।”
ভোলার এই ঘটনায় আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আসার পর এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল জেলা পুলিশ সুপার শরীফুল হকের কাছে।
পুলিশ সুপার মি. হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আসামিদের রাজনৈতিক বা অন্য কোনো পরিচয় আছে কি-না এটা আমাদের কাছে মুখ্য না। অপরাধীকে আমরা অপরাধী হিসেবেই দেখি।”
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা