
কার তারেক রহমানের সঙ্গে ছবি আছে, কার বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছবি আছে, এক শ্রেণির সাংবাদিক এখন এগুলো ফেইসবুকে প্রকাশ করে, নানা গল্প লিখছেন। হাওয়া ভবনের সেলফিটা এখনো কেউ দিচ্ছেন না। কিছুদিনের মধ্যে সেটাও পেয়ে যাবো হয়তো। চামচামির নানা স্মৃতি স্মরণ করানো হচ্ছে।
গত ১৬ বছর তারা এসব ছবি লুকিয়ে রেখেছিলেন। তখন আরেক শ্রেণির সাংবাদিক ছবি দিতেন শেখ হাসিনার সঙ্গে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, জয়ের সঙ্গে, রেহানা আপার সঙ্গে।কাওরান বাজারের একজন লেখক সাংবাদিক, ছোটআপাকে নিয়ে, ‘আপা তোমার আব্বুকে একবার আব্বু ডাকতে চাই’ এমন কলামও লিখেছিলেন। এক সাংবাদিক দম্পতি গণভবনে শেখ রেহানার সঙ্গে ছবি ফেইসবুকে দিয়ে লিখেছিলেন, আপা দোয়া দিয়েছেন। এর পর শত শত কমেন্ট। সবাই সফলতা কামনা করেছেন।
অথচ এই দম্পতির একজন দীর্ঘদিন আমার সহকর্মী ছিলেন। আমি তার বসই ছিলাম। তার রিপোর্টিংএর যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা আছে। কিন্তু তার বিত্তবৈভব অঢেল হয়েছে যে তিনি নিজেই বড় একটা মিডিয়া করতে যাচ্ছেন এমনাটাই চাউর হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকলে হয়তো চাকরির জন্য আমার যেতে হতো তার কাছে। হঠাৎ পতন হয়ে গেছে।
মাঠেঘাটের সাংবাদিক হওয়ায় আড়াইযুগে কতোকিছু দেখলাম। কতোজনের কতো পরিবর্তন দেখলাম। এক সাংবাদিক নেতা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের আত্মীয়,সে পরিবারে বিয়ে করেছেন এ পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন বিগত সময়। অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। কিন্তু এখন নিশ্চুপ। এখন হাওয়া ভবন ঘনিষ্ট সাংবাদিক কোথাও গেলে ফেইসবুকে তার পোস্টে নানা পরামর্শ দেন।
আরেক সাংবাদিক নেতা পুলিশের কুখ্যাত বেনজিরকে মামা ডাকতেন। এ নিয়ে তার গর্বের অন্ত ছিলো না। আমি একবার জানতেও চেয়েছিলাম বেনজির কেমন মামা! তিনি চোখ লাল করে বলেছিলেন, কেনো তুমি জানো না! আমার মায়ের খালাতো ভাই।
আমি নিশ্চিত এখন যদি বলি, ভাই আপনার মামা বেনজির কোথায়? তিনি উল্টো ক্ষেপে বলবেন, বেনজির আবার আমার মামা কবে হলো? তুমি গুজব ছড়াচ্ছো!! কুখ্যাত পুলিশ হারুণের বন্ধু সাংবাদিক অনেকেই এখন ভোল পাল্টিয়ে ফেলেছেন। হারুণকে মহান পুলিশ কর্মকর্তা বানিয়ে ডকুমেন্টারি করা এক টেলিভিশনের পাওয়ারফুল লোক এখন পার্লামেন্ট ডিবেট করে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
অদ্ভুত এক দুনিয়া। অদ্ভুত কিছু মানুষ।
এই চামচা শ্রেণির সাংবাদিকরাই বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাটাকে বিতর্কিত করে ফেলেছে। এদের কাউকেই আমি ৫০০ শব্দের কোনো রিপোর্ট কখনো লিখতে দেখিনি। তারা রাজনৈতিক নেতাদের অনুষ্ঠান কাভার করে সিন্ডিকেট রিপোর্ট, ফরমাইসী রিপোর্ট ছাড়া আর কিছু করতে দেখিনি। সাংবাদিকতার কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট, এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট কখনো করতে দেখিনি। তাদের যোগ্যতা দলীয় নেতাদের চামচামি করা, ক্লাব ইউনিয়নে নেতাগিরি করা, চাঁদাবাজি করা। এদের কারণে শেষ হয়ে যাচ্ছে সাংবাদিকতা। ৫০ বছরেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারে নি পেশাটি। এদের কারণে কোনঠাসা হয়ে থাকতে হয় পেশাদার প্রকৃত সাংবাদিকদের। যারা নিউজকে নিউজ হিসেবেই লিখতে চান, প্রকাশ করতে চান।। তারা অসহায়। এটা তখনো, এখনো।
তবে এবারের পরিবর্তনটা ভয়ঙ্কর। আগে চামচারা দাপিয়ে বেড়ালেও নিজেদের অযোগ্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারতো। রিপোর্ট লেখার জন্য পরামর্শ চাইতো, ইন্ট্রো কি হবে জানতে চাইতো, মাঝে মাঝে রিপোর্টের আইডিয়া নিতো। তারা একটা ভয়ে ভয়ে থাকতো।
কিন্তু এবার পুরো দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এবার যারা নতুন করে চামচামিতে নামছেন, জোরজবরদস্তি করে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পদে যাচ্ছেন তারা, চামচামি ও ক্ষমতাকেই যোগ্যতা হিসেবে মনে করছেন। রিপোর্ট লিখা বা রিপোর্ট খুঁজে বের করাকে তারা দায়িত্ব মনে করছেন না। তারা সাংবাদিকতার সংজ্ঞাই পাল্টে দিচ্ছেন।
আমার কিছু খারাপ স্বভাব আছে। সামনাসামনি বলে দেয়া। যে যেটা পারে তার সেটা স্বীকার করা। যে যা পারেন না তাকে সেটাও বলে দিই। এটা অপছন্দ করতে পারেন। কিন্তু আমি আমার সত্যে অটল। আমি নিজেকে চিনি। ‘নো দাইসেলফ’ আমি পড়েছি।
সেদিন নতুন ক্ষমতাপাওয়া আমার এক কনিষ্ঠ ভ্রাতা বললো, দাদা আমি অমুক পত্রিকায় জয়েন করেছি, বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। আমি টাসকি খেয়ে গেলাম। বিশেষ প্রতিনিধি!!
বললাম, তোমার বিশেষ রিপোর্ট আমি কখনো পড়িনি। সে হয়তো হতাশ হয়েছে আমার ওপর।
আমি নিজেও কখনো বিশেষ প্রতিনিধি হতে পারিনি। শিক্ষানবিশ রিপোর্টার থেকে সিনিয়র রিপোর্টার হয়ে নিউজ ম্যানেজমেন্টে চলে গিয়েছিলাম। ধাপে ধাপেই পেশাগত জীবন এগিয়েছে। জয়েন্ট নিউজ এডিটর, নিউজ এডিটর, সিনিয়র নিউজ এডিটর, ডেপুটি চীফ নিউজ এডিটর এ ভাবেই এগিয়েছে। আইনেও তা বলা আছে। একজন বিশেষ প্রতিনিধিকে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাকে সপ্তাহান্তে এমন বিশেষ রিপোর্ট বের করতে হয় যা পড়ে পাঠক নতুন তথ্য জানতে পারে। রিপোর্টটি মনে রাখতে পারে। সব রিপোর্টার বিশেষ রিপোর্টার হতে পারে না।
সাংবাদিকতার প্রতিটা ধাপই এনজয় করার মতো। সাংবাদিকতা পেশাটা উপভোগ করার মতো। এটা বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার পেশা। এটা গুরুমুখি পেশা। কলম পিষতে পিষতে শিখতে হয়। সিনিয়রদের কাছ থেকে শিখতে হয়। পড়াশোনা করতে হয়। ‘পেন ইজ মাইটার দ্যান সোর্ড’ এটা এমনি এমনি আসে নি। এটা কর্পোরেট পেশা না। সাংবাদিকতাও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইন সভ্যতার বিকাশ। আইন, নিয়মকানুন মেনে সাংবাদিকতা চলতে হবে। কোনো পেশা যদি আইন মোতাবেক না চলে, নিয়ম কানুন মেনে না চলে তা হলে সেটা আর পেশা থাকে না। সাংবাদিকতা সেদিকেই চলে যাচ্ছে। এ পেশা রক্ষা করার দায়িত্ব সবার। রাষ্ট্রের ফোর্থ স্টেট বলা হয় মিডিয়াকে। কিন্তু এই স্টেটকে রক্ষা করবে কে? কে এগিয়ে আসবে? সাংবাদিকদের মধ্যেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। সিনিয়রদের এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকেও এই দায়িত্ব নিতে হবে। সাংবাদিকতা করা অপরাধ না। চামচারা সাংবাদিকতা ছাড়ুন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলাম লেখক শংকর মৈত্রের ওয়াল থেকে
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখা লেখকের একান্তই নিজস্ব, লেখকের এই লেখার সাথে আমাদের সম্পাদকীয় নীতির কোন মিল নেই