
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
নিশ্চিতে ২০০৯ সালে খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প চালু করে সরকার। এর অধীনে ভর্তুকি মূল্যে কৃষককে কৃষি যন্ত্রাংশ সরবরাহের কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা পাননি কৃষকরা, বরং বঞ্চিত হয়েছেন। আর সে জায়গায় প্রকল্পের প্রায় পুরো মধু গিলে খেয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অভিযোগ আছে, কৃষকদের জন্য ভর্তুকি মূল্যের এসব যন্ত্রাংশ রাজনৈতিক প্রভাব আর ঘুষসহ নানাভাবে বাগিয়ে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েকজন প্রভাবশালীর সহায়তায় এসিআই মোটরসকে যন্ত্র সরবরাহে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে যন্ত্রাংশ বিক্রির অভিযোগও।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম জাতীয় পত্রিকা দৈনিক কালবেলা। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালে এনলিস্টেড কোম্পানির তালিকার এসিআইসহ চারটি কোম্পানি ছিল। এরপর ২০২০ সাল পর্যন্ত আর কোনো কোম্পানিকে এনলিস্টেড করতে দেওয়া হয়নি। বাকি তিনটি কোম্পানিও যাতে কাজ না পায়, সেজন্য পিডির মাধ্যমে নানা অহেতুক মানদণ্ড (ক্রাইটেরিয়া) দেওয়া হতো। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বড় কর্তারা এসিআই থেকে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের ঘুষ। এভাবেই অধিদপ্তরে বিগত হাসিনা সরকারের আমলে প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এসিআই মোটরসের। আর অন্য কোনো প্রতিযোগী না থাকায় দাম নির্ধারণ থেকে সবকিছুই হতো এসিআই মোটরসের নিয়ন্ত্রণে। ফলে বিভিন্ন যন্ত্রে দু-তিনগুণ দাম ধরাসহ অভিযোগ রয়েছে টাকা দিয়েও যন্ত্র না পাওয়ার। বিষয়টি ধরা পড়েছে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তদন্তেও।
গত বছরের জুনের ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপিপির (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) নির্দেশনা না মানা; কারিগরি কমিটির পরামর্শ উপেক্ষা তথা অমান্য করে বেশি দরে যন্ত্রপাতি কেনা এবং নতুন আসবাবপত্র মেরামত দেখিয়ে অর্থ ব্যয় করা; বাজারদর যাচাই না করে উচ্চদরে কৃষিযন্ত্র কেনা; নিম্নশক্তির (হর্স পাওয়ার) কৃষিযন্ত্র সংগ্রহ তথা কেনা ও কৃষকদের সরবরাহ করা; নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা সত্ত্বেও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের জরিমানা না করে অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ করা; কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং প্রকল্পের বার্ষিক সীমার অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করার মতো অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।
প্রতিবেদনটি আরও বলছে, ২০১০ সালের জুলাইয়ে দুই বছর মেয়াদি ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন’ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। এরপর দুই দফা সময় বাড়িয়ে দুই বছরের প্রকল্পে টেনে আনা হয় ২০১৯ সাল পর্যন্ত। সব মিলিয়ে প্রকল্প খরচ দাঁড়ায় ৪৯৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পিডি ছিলেন শেখ মো. নাজিম উদ্দিন ও উপপ্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম শেখ। তবে প্রকল্পের শুরু থেকেই ছিল দুর্নীতি আর অনিয়মের নানা অভিযোগ। ২০১৯ সালের আগে বিতরণ করা অনেক যন্ত্রের এখন আর হদিস নেই। কিছু যন্ত্র নষ্ট হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পরে আরও ১ হাজার ৮০০ যন্ত্র ক্রয়ে প্রায় ৭০ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হলেও একটিরও হদিস পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে ওই প্রতিবেদক জানতে পারেন, কিশোরগঞ্জ সদরে ১৯টি কম্বাইন হারভেস্টার বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে কয়েক মাস খুঁজেও তার একটিও পাওয়া যায়নি। কৃষি কর্মকর্তাদের কাছেও এর কোনো তথ্য নেই। ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুল ইসলাম পেয়েছেন কৃষকের ভর্তুকির পাওয়ার টিলার। সাবেক পৌর মেয়র কফিরুল আলমের ছেলে রাইস মিল ব্যবসায়ী আমির সোহেল কৃষক না হলেও তাকে কেনার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে পাওয়ার টিলার। একই উপজেলার সেনুয়া গ্রামের ইউপি সদস্য তবির উদ্দিন পাওয়ার টিলার পেয়েই এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। অথচ তিন বছরের মধ্যে এ যন্ত্র হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। আবার ভর্তুকির ৭২ হাজার ৬৭৫টি যন্ত্রের প্রায় ৭০ হাজার যন্ত্র পিডি শেখ মো. নাজিম উদ্দিন, বেনজির আলম, ডিপিডি শফিকুল শেখসহ তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ম্যানেজ করে সরবরাহ করা হয়েছে। এই যন্ত্রগুলোতে মোট ভর্তুকি অর্থ বরাদ্দ ছিল ৩৩৮ কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, কৃষকরা ভর্তুকির মাধ্যমে প্রকল্পের ১০ শতাংশ যন্ত্রও পাননি। অনেক জায়গায় কৃষককে যন্ত্র দিয়ে ছবি তুলে তা আবার ফেরত নিয়ে অন্যজনকে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের কয়েকশ কোটি টাকা এসিআই মোটরসের মাধ্যমে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাসহ পিডি ও ডিপিডির পকেটে ঢুকেছে। এ ছাড়া ৩৭৫টি প্রদর্শনী যন্ত্রের জন্য ৮ কোটি ১৭ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও যন্ত্রাংশ কেনার পর থেকে উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয়ে শেড নির্মাণ করে বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে। ওই যন্ত্রগুলো দিয়ে কোনো প্রদর্শনী করা হয়নি, যা এখন নষ্ট হয়ে ভাঙাড়ি হিসেবে বিক্রি ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এতে এই খাতে ব্যয় হওয়া পুরো অর্থই অপচয় হয়েছে। অন্যান্য প্রদর্শনীর জন্য ১৪ কোটি টাকার কৃষিযন্ত্র মেরামত ও পরিবহনে ৫ কোটি টাকা খরচ দেখানো হলেও তা খাতা-কলমেই। এই অর্থ এসিআই মোটরস ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত খরচকে বিভিন্ন বিল-ভাউচারের মাধ্যমে সমন্বয় করার অভিযোগ রয়েছে।
কালবেলার ওই প্রতিবেদন বলছে, এসিআই মোটরসের যোগসাজশে সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, পিডি শেখ মো. নাজিম উদ্দিন ও ডিপিডি মো. শফিকুল ইসলাম শেখের মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল ওই অসাধু সিন্ডিকেট। ডিপিডি শফিকুল ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এরপর ২০২০ সাল থেকে তিনি সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের একই দায়িত্ব পালন করছেন। প্রায় ১৪ বছর যান্ত্রিকীকরণ বিষয়ক দুই প্রকল্পের একই পদে থাকা নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে নানান গুঞ্জন। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের দুটি প্রকল্প থেকে লুটপাট করছেন শফিকুল ইসলাম।
অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তা ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এসিআই মোটরসকে একচেটিয়া (মনোপলি) ব্যবসা চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তার নির্দেশেই প্রকল্পে নতুন কোনো কোম্পানিকে এনলিস্টেড করতে দেওয়া হতো না। তখনকার বরাদ্দের সিংহভাগ যন্ত্র বিতরণ করত এসিআই। দুর্নীতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও মন্ত্রণালয় থেকে শফিকুল ইসলামকে ফের একই ধরনের প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ থাকায় ডিপিডি শফিকুল ইসলাম ও এসিআিই মোটরসের দাপটে অনেক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন খামারবাড়িতে কোণঠাসা ছিলেন। কৃষিখাতে একচ্ছত্র অধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে এসিআই মোটরস এবং এসিআই এগ্রিবিজনেজ কোম্পানি তাদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে খামারবাড়িতে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অনৈতিক সুবিধা দিত। কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, কৃষকদের টাকা যেভাবে লুটপাট করা হয়েছে তা দুঃখজনক। এই দুর্নীতি এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি এসিআই কোম্পানিকে জরিমানসহ কালো তালিকাভুক্ত করার দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে পিডি শেখ মো. নাজিম উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়েছে। কোনো মনোপলি ব্যবসা হয়নি। অনেক কোম্পানি এনলিস্টেড ছিল। কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়নি এ প্রকল্পে।’
এসব বিষয়ে জানতে এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাসকে একাধিকবার ফোন করেছেন দৈনিক কালবেলার এই প্রতিবেদক। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠালে তিনি দেশের বাইরে আছেন জানিয়ে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। এরপর মো. জাহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নিজেকে জেনারেল ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদককে ফোন দেন। তিনি প্রশ্ন শুনে জেনারেল ম্যানেজার ইয়াসির নামের একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। তার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ইয়াসির নামের ওই ব্যক্তিকে ফোন দিলে প্রশ্ন শুনেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আপনি ওই প্রকল্প নিয়ে কথা বলছেন, এখন যে পুকুর চুরি হচ্ছে সেটা দেখেন না। এখন আপনাদের কাছে কেউ অভিযোগ দেয় না?’ এরপর তিনি এই প্রতিবেদককে অকথ্য ভাষায় ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করেন।