
অনলাইন ডেস্কঃ
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা দিতে সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৩০টি আসনে ব্যাপক রদবদল এনেছিল বিগত এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন। বিগত সেনা সমর্থিত ঐ কমিশন বেছে বেছে বিএনপির আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করে। সেই সময়ে ঢাকায় আওয়ামী লীগকে বাড়তি সুবিধা দিতে কুমিল্লাসহ ১২টি জেলার সাড়ে ১০টি সংসদীয় আসন কর্তন করেছিল কমিশন। ঢাকা জেলায় ১৩টি থেকে সংসদীয় আসন করা হয় ২০টি। যে ১২টি জেলা থেকে আসন কর্তন করা তার মধ্যে ১০টি জেলায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির দখলে ছিল। একটি জামায়াতের আর অন্যটি ছিল আওয়ামী লীগের। এ টি এম শামসুল হুদার আমলে আসন অবিকল বহাল রেখে টুকটাক আসন বিন্যাস করে দায়িত্ব শেষ করে গেছে বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনকারী কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, কে এম নূরুল হুদা এবং কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। নতুন কমিশন গঠনের পর বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ২০০৮ সালের আগের সীমানা ফেরত দেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নবগঠিত এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য বেশকিছু আবেদন জমা পড়েছে। আবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। কমিটি যাচাইবাছাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সীমানা পুনর্নির্ধারণে আওয়ামী লীগকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কারণে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ২৩০টি আসন নিয়ে জয়লাভ করে। সামান্য ব্যবধানে বেশির ভাগ আসনে বিএনপির প্রার্থীদের কাছ থেকে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একতরফা, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি ডামি নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় ছিল ছাত্র-জনতায় গণবিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা একাধিক বার বলেছিলেন, ঢাকা মহানগরীতে সংসদীয় আসন সীমিত রেখে অন্যান্য জেলায় আসন পুনর্বিন্যাস করতে হবে। এক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী জনসংখ্যা নয়, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় আনতে হবে।
২০০১ সালের নির্ধারিত সীমানায় ফিরে গেলে ভালো হয়। ২০০৮ সালে প্রশাসনিক ইউনিটগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়। সীমানা পুনর্নির্ধারনের ওপর এক জন প্রার্থীর জয়-পরাজয়ও নির্ভর করে। ফলে এক্ষেত্রে কোনোভাবে অনিয়ম ও পক্ষপাত গ্রহণযোগ্য নয়। কারোর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কমিশনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করা উচিত।
অনুসন্ধান দেওয়া গেছে, আইনানুযায়ী প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ করা হয়। বিগত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ টি এম হুদা কমিশনের সংসদীয় আসন ব্যাপক ওলটপালট করার ফলে সারা দেশে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিই ২০০৮ সালে সীমানা পুনর্নির্ধারণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত হয়েছে গ্রামাঞ্চলের জনগণ। আসন বিন্যাস করতে গিয়ে পুরো দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব করে বিগত কমিশন। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারা দেশের সংসদীয় আসনগুলো একইরূপে থাকলেও ২০০৮ সালে এসে হঠাৎ করে ব্যাপক রদবদল আনে বিগত কমিশন। বিএনপির আসনগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো করা হয়। যেসব আসনে দীর্ঘদিন ধরে সেনাসমর্থিত সরকার ও তার সমর্থকদের বিপক্ষের বিশেষ করে বিএনপি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল সেসব আসনই পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে কোনো আপত্তি বা মামলায় আমলে নেয়নি কমিশন। আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করার জন্য অসংখ্য আবেদন জমা পড়ে কমিশনে। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী তার আবেদনে বলেন, একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে সামনে রেখে বিগত কমিশন সীমানা পুনর্বিন্যাস করে। এতে একটি রাজনৈতিক দলই বেশি লাভবান হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনগণ। কোনো কিছুই আমলে না নিয়ে অস্বাভাবিকভাবে পুনর্বিন্যাস করা সীমানা বহাল রেখে দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা হয়।
বিএনপির আসন পুনর্বিন্যাস: যেসব আসনে বিএনপির জনপ্রিয়তা বেশি ছিল সেইসব আসনগুলো পুনর্বিন্যাস করে কমিশন। সবচেয়ে বেশি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়, ঢাকায় ১৯টি, চট্টগ্রামে ১০টি ও কুমিল্লায় ৭টি। এছাড়াও নোয়াখালী ৫টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৫টি, সিলেট ৪টি, নরসিংদী ৪টি, গাজীপুর ৪টি, ময়মনসিংহ ৪টি, যশোর ৪টি, সিরাজগঞ্জ ৪টি, বগুড়ায় ৪টি, রাজশাহী ৩টি, খুলনা ৩টি, পটুয়াখালী ৩টি, বরিশাল ৩টি, টাঙ্গাইল ৩টি, মুন্সীগঞ্জ ৩টি, নারায়ণগঞ্জ ৩টি, মৌলভীবাজার ৩টি, চাঁদপুর ৩টি, ফেনী ৩টি, কুড়িগ্রাম ২টি, সাতক্ষীরা ২টি, বরগুনা ২টি, পিরোজপুর ২টি, নেত্রকোনা ২টি, কিশোরগঞ্জ ২টি, মানিকগঞ্জ ২টি, ফরিদপুর ২টি, শরীয়তপুর ২টি, সুনামগঞ্জ ২টি, লক্ষ্মীপুর ১টি, কক্সবাজার ১টি আসন। উপরি উক্ত আসনগুলোয় বিগত সময়ে বিএনপির অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল।
যে ১৩০টি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়: খাতা কলমে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন ৮৪টি আসন পুর্নবিন্যাস করার কথা বললেও বাস্তবে তারা আসন বিন্যাস করেছিল ১৩০টি। আসনগুলো হলো—ঢাকা বিভাগ : টাঙ্গাইল-১, ৫, ৬, কিশোরগঞ্জ-১, ২, ফরিদপুর-২, ৪, শরীয়তপুর-২,৩ মানিকগঞ্জ-১, ২, জামালপুর-২,৩,৪,৫, নেত্রকোনা-২,৫, ময়মনসিংহ-১, ২, ৩, ৪, ঢাকা-১,২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ গাজীপুর-১,২,৩,৫, নরসিংদী-১, ২, ৩, ৫ নারায়ণগঞ্জ-২, ৩, ৪, মুন্সীগঞ্জ-১, ২, ৩, সিলেট বিভাগ : সুনামগঞ্জ-৪, ৫ সিলেট-১, ২, ৩, ৪ মৌলভীবাজার-১, ২, ৪। কুমিল্লা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১, ২, ৩, ৫, ৬, কুমিল্লা-১, ২, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, চাঁদপুর-১, ২, ৩,। চট্টগ্রাম বিভাগ : ফেনী-১, ২, ৩, নোয়াখালী-১, ২,৩, ৪, ৫, লক্ষ্মীপুর-৪, চট্টগ্রাম-৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১৩, ১৪, কক্সবাজার-১। বরিশাল বিভাগ : বরগুনা-১, ২, পটুয়াখালী-১, ২, ৩, বরিশাল-২, ৩, ৪, পিরোজপুর-২,৩। খুলনা বিভাগ : যশোর-৩, ৪, ৫, ৬, খুলনা-১, ৪,৬, সাতক্ষীরা-৩,৪। রাজশাহী বিভাগ : রাজশাহী-২, ৩, ৪ কুড়িগ্রাম-২, ৩, বগুড়া-১, ৫,৬, ৭, সিরাজগঞ্জ-১, ২,৫,৬ সহ মোট ১৩০টি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়।
১২টি জেলায় বিএনপির নিয়ন্ত্রণ ছিল : যে বারোটি জেলার আসন কর্তন করা হয় সেই জেলাগুলো ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। বারোটি জেলার সাড়ে ১০টি আসনের মধ্যে সাড়ে আটটিরই নিয়ন্ত্রণ ছিল বিএনপির। এর মধ্যে ২০০১ সালে বিলুপ্ত কুমিল্লা-৯ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন আলহাজ মনিরুল হক চৌধুরী, বরগুনায় বিএনপির মতিউর রহমান তালুকদার, চাঁদপুরে বিএনপির মো. নুরুল হুদা, ফরিদপুরে বিএনপির কামাল ইবনে ইউসুফ, স্বরুপকাঠি-বানাড়িপাড়া আসনে (বরিশাল-পিরোজপুর) বিএনপির সৈয়দ শহীদুল হক জামাল, সিরাজগঞ্জে বিএনপির মেজর (অব:) মঞ্জুর কাদের, ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা আসনে বিএনপির ডা. মোহাম্মদ আলী, মুন্সীগঞ্জে বিএনপির মো. আবদুল হাই, মানিকগঞ্জে বিএনপির হারুন-অর রশিদ খান মুন্নু, কিশোরগঞ্জে আওয়ামী লীগের ড. আলাউদ্দিন আহমদ এবং সাতক্ষীরার বিলুপ্ত তিন আসনে এমপি ছিলেন জামায়াত ইসলামের মাওলানা রিয়াসাত আলী। বিএনপির অধ্যুষিত উপরের আসনগুলো কেটে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, রাজশাহী ও নেত্রকোনায় বৃদ্ধি করা হয়।
আইন লঙ্ঘন করেছিল কমিশন : ১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশের ৮ ধারায় বলা আছে, ‘আদমশুমারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের জন্য পুনরায় আসনসমূহের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। ৬ ধারায় বলা আছে, আঞ্চলিকভিত্তিক প্রশাসনিক সুবিধার বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে এবং তা করতে গিয়ে যতদূর সম্ভব সর্বশেষ আদমশুমারির প্রতিবেদনের জনসংখ্যার বিভাজনও বিবেচনায় রাখতে হবে’। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে ১৯৭৬ সালের সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ অমান্য করেছিল বিগত কমিশন। কমিশন আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিল। জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে আসন পুনর্বিন্যাস করে ঢাকা মহানগরীর আসন সংখ্যা আট থেকে বাড়িয়ে ১৫টি করতে হয় কমিশনের। পরে অবশ্য বিগত কমিশন জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বিন্যাসকে ‘বড়’ ভুল হয়েছে বলে অ্যাখ্যা দিয়েছিল। এ জন্য বিদায়ের আগ মুহূর্তে এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন ঢাকার আসন ১০টি করার জন্য সরকারের কাছে চলতি বছরের প্রথমদিকে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। যদিও বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাব পরে বর্তমান কমিশনের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।
৪ হাজার আপত্তি আমলে নেয়নি কমিশন: যে ১৩০টি আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল সেসব এলাকা থেকে ২০০৮ সালের জুনের দিকে ৩ হাজার ৬৯০টি আপত্তি জমা পড়ে কমিশনে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩৮টি নির্বাচনি এলাকা থেকে ৬০৯টি, চট্টগ্রাম বিভাগের ২২টি নির্বাচনি এলাকা থেকে ১ হাজার ১৪৪টি, রাজশাহী বিভাগে ১৩টি নির্বাচনি এলাকা থেকে ৬২৮টি, খুলনা বিভাগে ছয়টি নির্বাচনি এলাকা থেকে ১ হাজার ১৪১টি, সিলেট বিভাগে সাতটি নির্বাচনি এলাকা থেকে ২৩টি এবং বরিশাল বিভাগের ৯টি নির্বাচনি এলাকা থেকে ১৪৫টি আপত্তি পাওয়া যায়। বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকার আপত্তিগুলো আমলে নেয়নি কমিশন। পরে শুনানি শেষে সীমানা পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত ১৯৭৬ সালের অধ্যাদেশ এর ধারা ৬ (৪) অনুযায়ী আপত্তিগুলো খারিজ করে ১৩০টি সীমানা পুন:নির্ধারণ করে ২০০৮ সালের ১০ জুলাই গেজেট প্রকাশ করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৫ (ক) অনুযায়ী, সংসদীয় নির্বাচনি এলাকার সীমা নির্ধারণ কিংবা অনুরূপ নির্বাচনি এলাকার জন্য আসন বন্টন সম্পর্কিত যে কোনো আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপিত করার সুযোগ নেই। তবে সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত ১৩টি মামলা হয়। পরে আদালত মামলায় কমিশনের অনুকূলে রায় প্রদান করেন।
১৭টি জেলার আসন হ্রাস-বৃদ্ধি: ১৭টি জেলার আসন হ্রাস-বৃদ্ধি করেছিল বিগত কমিশন। এর মধ্যে ১২টি জেলা থেকে ১০.৫টি আসন কর্তন করা হয়। তার মধ্যে ৯টি জেলা থেকে একটি করে আসন কর্তন করা হয়েছিল। জেলাগুলো হলো—সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, বরগুনা, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, কুমিল্লা। আর পিরোজপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ থেকে ৫ শতাংশ আসন কাটা হয়। আসন বৃদ্ধি করা হয়, ঢাকায় সাতটি, চট্টগ্রামে একটি, গাজীপুরে একটি, রাজশাহীতে একটি ও নেত্রকোনায় অর্ধেক আসন।
২০০৮ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টন করায় বিগত সংসদ নির্বাচনে ঢাকা জেলায় সাতটি, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা ও গাজীপুরে একটি করে আসন বেড়ে যায়। অন্যদিকে, ১২টি জেলার আসন কমাতে হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকে। এর ফলে ১৩০টি আসনের সীমানা ওলটপালট হয়ে যায়। যদিও বিদায়ি নির্বাচন কমিশন (ইসি) জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন বণ্টনের নীতি ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। তবে এবারও যদি আগের নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলের আরো ১০টি জেলায় সংসদীয় আসন কমে যেতে পারে।
সংবিধানের ১১৯(গ) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণ করে নির্বাচন কমিশন। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরোনো একটি আইন ব্যবহার করে। পরবর্তী রকিব কমিশন নিজেদের মতো আইন করে। অভিযোগ রয়েছে নিজেদের চিন্তাধারা ও পছন্দ বাস্তবায়নের জন্য তারা তাদের মতো করে নীতিমালা প্রণয়ন করে। আইনে বর্তমান সীমানা যতদূর সম্ভব বহাল রাখার কথা বলা হলেও ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৩০টি আসনেরই আগের সীমানা তারা বদলে দেয়। উপজেলা অবিভাজিত রাখার নির্দেশনা থাকলেও গাজীপুর সদর উপজেলাকে চারটি ভাগে, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলাকে তিন ভাগে, ভাণ্ডারিয়া উপজেলাকে দুটি ভাগে, মতলব উপজেলাকে দুটি ভাগে, সিরাজগঞ্জ উপজেলাকে দুটি ভাগে এবং রাজধানীর প্রায় সব থানাকে তিন থেকে চারটি ভাগ করে নির্বাচনি এলাকার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
নদী ও রাস্তাঘাট বিবেচনা করা হয়নি: ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, যথা—নদী ও রাস্তাঘাট বিবেচনার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মান হয়নি। ১৯৭৯ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভাণ্ডারিয়া ও কাউখালি উপজেলা নিয়ে একটি আসন থাকলেও ২০০৮ সালে এসে তার সঙ্গে যুক্ত করা হয় নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলাকে। যদিও নদীপথ ছাড়া ভাণ্ডারিয়ার সঙ্গে নেছারাবাদের যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরত্বের এই দুই উপজেলার মধ্যখানে রয়েছে দুটি বড় নদী। এইভাবে অনেক নির্বাচনি এলাকার ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও প্রশাসনিক সুযোগ-সুবিধাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
উন্নয়নবঞ্চিত হয়েছে গ্রামাঞ্চল: কাজী রকিবউদ্দীন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে শহরাঞ্চলে সংসদীয় আসন বৃদ্ধির ফলে গ্রামাঞ্চলে উন্নয়ন কমছে বলে উল্লেখ করা হয়। একটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় এলাকায় যে পরিমাণ সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়—একাধিক উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় এলাকায়ও একই পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়। বৈঠকে বলা হয়, ঢাকায় আসন বাড়ানোর ফলে গ্রামের আসন কমেছে। ফলে গ্রামের উন্নয়নবরাদ্দও কমেছে। ঢাকার উন্নয়নে নানাবিধ প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু গ্রামের উন্নয়নে তেমন কোনো স্বাধীন প্রকল্প থাকে না। বাত্সরিক সরকারি বরাদ্দের ওপর নির্ভর করে গ্রামীণ উন্নয়ন।
এটিএম শামসুল হুদার পথ অনুসরণ করে ২০১৩ সালে এসে ৫০টি আসনে, ২০১৮ সালে এসে ২৫টি আসনে সর্বশেষ ২০২৩ সালে ১০টি আসনে পরিবর্তন এনেছিল আওয়ামী লীগের আমলে গঠিত কমিশনগুলো। এসব আসন বিন্যাসের ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন করে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের আলোচনা সামনে এসেছে। বিএনপি বলেছে, ১৯৮৪ সালে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সীমানা নির্ধারণ করে ৮৬, ৯১, ৯৬, ২০০১ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেটাই ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে। নবগঠিত কমিশনের নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের নেতৃত্বে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি দ্রুত তাদের কার্যক্রম শুরু করবে।
সূত্রঃ ইত্তেফাক