
বিশেষ প্রতিনিধি:
সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে ভোট বিপর্যয় নিয়ে অবশেষে মুখ খুললেন বিএনপির খুলনা মহানগর শাখার নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তুহিন বললেন, আমার ভোট বিপর্যয় হয়নি, কিছু মুখোশধারী বেইমানকে আমরা এবার চিনতে পেরেছি। যারা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে নিজের ভোটকে বিক্রি করেছেন। বিবেককে বিক্রি করেছেন। তারা নৈতিক অপরাধী।
আলাপকালে তুহিন বলেছেন, তবে তিনি সব ভুলে তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এই নিয়ে কোন দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ, অক্ষেপ, অভিমান, অভিযোগ নেই। কোন আফসোসও নেই। সবে সম্মেলন সিমাওত হয়েছে, রোজার মাস চলছে। তারপরেই ঈদ। আশা করি ঈদ গেলেই আমরা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবো
নিজ বাসভবনে অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় নিউজ ডটকমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তুহিন সদ্য সমাপ্ত সম্মেলন, আগামীতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, গেলো ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী অবস্থাসহ দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পরবর্তী দিনগুলির স্মৃতিচারন করে তুহিন বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতেই খুলনাতে লাখো মানুষ রাস্তায়। দেশে সরকার নেই। প্রশাসন নেই। পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পালিয়ে গেছে।
সারা খুলনায় তখন এক বিভীষিকাময় অবস্থা। রাজপথে অবস্থান নেয়া হাজার হাজার মানুষের জনস্রোত তখন আক্রমণমুখী। শেখ হাসিনার দুঃশাসন পরবর্তী পলায়নে তখন সবাই ক্ষুব্ধ। মানুষের চোখে মুখে তখন প্রতিহিংসার ভয়ানক চিত্র।
তুহিন বলেন, দলের সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে সারা খুলনা শহরে দলের শত শত নেতাকর্মীকে সাথে নিয়ে পাহারা দিয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকজন ফ্যাসিস্ট ছাড়া খুলনার নিরীহ কোন মানুষের বাড়ি ঘরে হামলা- ভাঙচুর হয়নি বা আগুন দিতে পারে নি।
তুহিন জানান, বড় বাজারের শত শত ব্যবসায়ীকে রাত দিন নিদ্রাহীন থেকে পাহারা দিয়েছি। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা দিয়েছি। আমাদের ছেলেরা তাদের বাড়িঘর- ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির পাহারা দিয়েছে। নতুবা খুলনা শহর কারবালা হয়ে যেতো।
আলাপকালে সদ্য সমাপ্ত দলের সম্মেলন ও কাউন্সিল প্রসঙ্গে এই সময়ের জনপ্রিয় নেতা, ৫৭ বছরের চির তরুন, সাবেক ছাত্রনেতা শফিকুল আলম তুহিন আরও বলেছেন, খুলনায় কাউন্সিল হয়েছে। প্রকাশ্যে ভোট হয়েছে। যে যার মতো মন খুলে ভোট দিয়েছে। কাঙ্খিত ভোট থেকে হয়তোবা কম ভোট পেয়েছি। এতে কোন আক্ষেপ নেই। এটাই বিউটি অব ডেমোক্রেসি। বিউটি অব পলিটিক্স।
সম্মেলন একশোভাগ সফল হয়ছে এমনটা দাবি করে তুহিন বলেন, বর্ণাঢ্য পরিবেশে আয়োজিত এ সম্মেলন নি:সন্দেহে আমার রাজনৈতিক জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। তারেক রহমান ও দলকে স্থানীয় সবার সহযোগিতায় নতুন কমিটি উপহার দিতে পেরেছি, এটাই সম্মেলনের সার্থকতা।
তিনি বলেন, খুলনার সম্মেলন- কাউন্সিল অধিবেশন, ভোটে নেতা নির্বাচন, সারা বাংলাদেশে আলোড়ন তুলেছে। নগরীর ৩১ টা ওয়ার্ড, দুটি ইউনিয়ন, পাঁচটি থানা কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে এবারের সম্মেলন সফলভাবে নেতা নির্বাচন করায় দেশব্যাপী খুলনা বিএনপি প্রশংসা পেয়েছে। তারেক রহমানের বরাত দিয়ে তুহিন জানান, সারা দেশে খুলনা বিএনপি এখন রোল মডেল। দলের নেতা-কর্মীদের মনে নতুন করে আশার আলো ছড়িয়েছে।
তুহিন জানান, সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনে খোদ দলের সম্মানিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রশংসা পেয়েছে। অসুস্থতা সত্ত্বেও দলের চেয়ারম্যান বেগম জিয়াও খুলনাতে ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনে নিয়মিত নজর রেখেছেন। উল্লাসিত হয়েছেন। গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতা নির্বাচিত হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
আলাপকালে আবেগ আপ্লুত হয়ে তুহিন বলেন, দু:খ লাগে যখন দেখি, দলের একজন ডেডিকেটেড কাউন্সিলর বা নিবেদিত ভোটার দুই- পাঁচ- দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তার ভোট বিক্রি করে দেয়। বিবেককে বিক্রি করে দেয়। এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। তখন সততা, নৈতিকতা, বিবেক, জ্ঞান, অর্জিত শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাও মেনে নেয়া যায়, যদি আমাদের চেয়ে যোগ্যতা সম্পন্ন বা রাজনীতিতে অধিকতর সক্রিয় প্রার্থীদের কাছে ভোট বিক্রি করতো বা তারা ভোট দিতো।
অনেকটা দাবি নিয়ে সাবেক ছাত্রনেতা- সাবেক যুবদল নেতা তুহিন বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা আমার- আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো ৷ কেউবা ভাই, কেউবা সন্তান স্নেহ সমতুল্য। পরম আত্মার আত্মীয়। নিজের স্ত্রী- সন্তানদের যতটুকু না সময় দেই তার চেয়ে দ্বিগুণ- তিনগুন সময় দেই দলের নেতা-কর্মীদের।
তারেক রহমান কেন তাকে নেতা হিসেবে বেছে নিলেন এমন প্রশ্নে দলের নগর শাখার সভাপতি, খুলনা- ২ আসনের সাবেক এমপি, দল থেকে অব্যহতি পাওয়া কেন্দ্রীয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ইঙ্গিত দিয়ে তুহিন জানান, তারেক রহমান জানেন, আমি ৯০ তে রাজপথে ছিলাম। তিনি জানেন, আমি জেনারেল মইনের শাসন আমলে জিয়া পরিবারের সাথে বেইমানি করি নি। দল ছেড়ে মাতৃসমতুল্য বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে বিএনপি থেকে মাইনাস করতে সংস্কারপন্থী হইনি।
তারেক রহমান আরও দেখেছেন, শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসন আমলে শাসক দলের সাথে আঁতাত করে রাজপথ ছাড়িনি, সরকারের সাথে আঁতাত করে নির্বাচনি প্যাকেজ ডিল করিনি বা ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে ব্যবসা বানিজ্য নেইনি। সেই জন্যই হয়তোবা তারেক রহমান আমাকে কাছে টেনেছেন। বিশ্বাস করেছেন। একজন কর্মী হিসেবে পছন্দ করেছেন- এমন মন্তব্য তুহিনের।
দুই মেধাবী সন্তানের জনক তুহিন জানান, আওয়ামী লীগ শাসন আমলের গত পনেরো বছর, আর ওয়ান ইলেভেনের দুই বছর মিলিয়ে মোট সতেরো বছর আমরা রাজপথে। হামলা- মামলা, গ্রেফতার আতংকে বাড়ি ছাড়া ছিলাম। কিংবা জেলে ছিলাম। শেখ হাসিনার আমলে আমরা জীবনের দীর্ঘ মুল্যবান সময় হারিয়েছি। তার ফ্যাসিস্ট আমলটা টোটালি ছিলো দুঃস্বপ্নের মতো।
তিনি বলেন, পরিবারের সদস্যরা মারা গিয়েছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় প্রিয়জনের লাশ দেখতে আসতে পারে নি। কিংবা ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতককে দেখতে আসতে পারেনি। স্ত্রী বা পরিবারের সদস্যদের অসুস্থতার সময়ে পাশে থাকতে পারেনি। এমন চিত্র সারা দেশের। দলের ছেলেরা গত সতেরো বছর জীবন বাঁচাতে অন্য শহরে গিয়ে রিকশা- ইজিবাইক পর্যন্ত চালিয়েছে। এর চেয়ে ট্রাজেডি আর কি হতে পারে?
তুহিন বলেন, সম্মেলন সফল করতে প্রতিবন্ধকতা ছিলো প্রচুর। হাজারও ষড়যন্ত্র হয়েছে আমাদেরকে ঘিরে। আহবায়ক কমিটিকে ঘিরে। বিদায়ী কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য বিএনপির এমন কোন কেন্দ্রীয় নেতা নেই, যাদের কাছে নালিশ করেনি একটি প্রতিপক্ষ।
দলের চেয়ারম্যান বেগম জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পর্যন্ত মৌখিক- লিখিত অভিযোগ গেছে দফায় দফায়। তারপরেও উৎসব মুখর সম্মেলনে আমরা একটি নির্বাচিত কমিটি দলকে, তারেক রহমানকে উপহার দিতে পেরেছি।
তুহিন দু:খ করে বলেন, সর্বশেষ অভিযোগ দিয়েছে, আমি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছি। অথচ খুলনাবাসী জানে, আমরা আশির দশক থেকেই পারিবারিকভাবে গাড়ি ব্যবহার করে আসছি, আল্লাহর অশেষ রহমতে পরিবার হিসাবে একেবারে গরিব বা অভাবি পরিবার না।
উল্লেখ্য, তিন বছর আগে নগর বিএনপি গড়ার দায়িত্ব পেয়েছিলেন খুলনা মহানগর বিএনপির দুই প্রজন্মের দুই নেতা। প্রথমে তিনজনের আহবায়ক কমিটি। যার আহবায়ক ছিলেন শফিকুল আলম মনা, সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা, সুন্দরবন কলেজের সাবেক ভিপি তরিকুল ইসলাম জহির আর সদস্য সচিব ছিলেন শফিকুল আলম তুহিন নিজে।
সাবেক নগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু- সাবেক কেসিসি মেয়র মনিরুজ্জামান মনির নেতৃত্বে মহানগর কমিটি কেন্দ্র থেকে ভেঙে দিলে ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে মনা- তুহিনের কমিটি দায়িত্ব পায়। খুলনার রাজনীতিতে তখন নেতা হিসাবে মঞ্জু ছিলেন আন প্যারালাল। মঞ্জুর পাহাড় সমান জনপ্রিয়তা- প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে মনা- তুহিনের পথ চলা ছিলো দুষ্কর ব্যাপার।
এই প্রসঙ্গে তুহিন জানান, শ্রদ্ধেয় তারেক রহমানের কাছ থেকে পাওয়া দায়িত্ব ছিলো পরম আমানত। এই দায়িত্ব ছিলো মর্যাদার। অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। তিনি আমাকে- আমাদের বিশ্বাস করেছেন। দায়িত্ব দিয়েছেন। নেতা হবার সুযোগ দিয়েছেন। সেটা জীবন বাজি রেখে পালন করার চেষ্টা করেছি। দলকে সুসংগঠিত করেছি।
আবেগে আপ্লুত তুহিন আরও বলেন, গত সতেরো বছর জেনারেল মইন ও শেখ হাসিনার আমলে যারা জেলে ছিলেন, তাদের পিসিতে টাকা দেয়া, জামিনের ব্যবস্থা করা, আদালতের বারান্দায় উকিলের পেছনে দৌড় ঝাপ করা, পালিয়ে থাকা নেতাদের বাড়িতে খোঁজ নেবার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। ছোটাছুটি করেছি।
তিনি বলেন, দলের কেন্দ্রীয় নেতা, খুলনা বিএনপির রাজনীতির অভিভাবক রকিবুল ইসলাম বকুল, আরেক নেতা আজিজুল বারি হেলালের পরামর্শে, সার্বিক নির্দেশনায়, তত্ত্বাবধানে দলে হেল্প ডেস্ক, লিগাল এইড সেকশন, মিডিয়া সেল গঠিত হয়েছে। তারেক রহমানের ৩১ দফা লিফলেট খুলনার ঘরে ঘরে পৌছিয়ে দিয়েছি। প্রস্য ৫০ হাজার নতুন সদস্য বিএনপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ৮০র দশক থেকে তুহিন বিএনপি পরিবারের সদস্য। ছাত্র রাজনীতির শুরুতে আজম খান কমার্স কলেজের ছাত্রদল নেতা ছিলেন। এর পরে মহানগর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ধাপে ধাপে মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি। মহানগর যুবদলের সভাপতি।
এরশাদ জামানা, গত সতেরো বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের মূহুর্ত পর্যন্ত রাজপথে সব সময়েই সক্রিয় তুহিন। অসংখ্য মামলায় দফায় দফায় জেল খেটেছেন।
দলের জন্য ডেডিকেটেড তুহিন আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক কর্মী। কঠোর পরিশ্রমী, কর্মীবান্ধব নেতা। একজন সুবক্তা হিসাবে দলের নেতা-কর্মীদের কাছে সমাদৃত। দিন রাত সব সময়েই সক্রিয়। তুহিন নিজেও বলেছেন। তিনি সব সময়েই ফোন ধরেন। নেতা- কর্মীদের অভাব অভিযোগ শুনেন। সমাধানের চেষ্টা করেন। তার বাসার দরজা সব সময়েই খোলা। তার সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে একজন তৃণমূল কর্মীরও কোন সমস্যা হয় না।
বনেদি ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান তুহিন ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত, দুই মেধাবী সন্তানের জনক। স্ত্রী লাকি একজন শিক্ষিকা। পরহেজগার মহিলা। অতিথি পরায়ণ। আজম খান কমার্স কলেজের সাবেক ছাত্রদল নেত্রী। কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সম্পাদক। লাকি বিয়ের পর থেকেই তুহিনকে সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছেন।