
অনলাইন ডেস্কঃ
ট্রেনে চড়ার গল্প আবারও ট্রেনে যাচ্ছি। এবারে ঈদের ট্রেন। ট্রেনের নাম ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’। যাচ্ছি পর্যটন শহর কক্সবাজারে। এমনিতেই ট্রেনে চড়া আমার খুবই পছন্দের, তার ওপর জানালার পাশে সিট। সেই সিটে বসতেই নিজেকে ‘পথের পাঁচালী’র অপু অপু মনে হলো। আর অমনি কানে সুর এল, ‘এবার আমায় ডাকলে দূরে, সাগর-পারের গোপন পুরে…।’
ট্রেনে চড়ার চেয়ে আমার বেশি পছন্দ ট্রেনের বাঁশি শোনা। প্রতিটি ট্রেনেই শেষে বগির পেছনে বৃত্তের মধ্যে একটা লাল রঙের ক্রস চিহ্ন থাকে। সেই চিহ্ন দেওয়া বগিতে থাকেন রেলের গার্ড। স্টেশন ছাড়ার আগে তিনি পানের পিক ফেলেন, তারপর সবুজ পতাকা নাড়িয়ে বাঁশিতে ফুঁ দেন। গার্ডের মুখের পানে থাকে ঘরের টান, হাতে বাঁশি। আমার কাছে বাঁশি নামেই সেই সুদূরের ডাক—তা যে-ই বাজান, হোক রেলের গার্ড কিংবা চৌরাসিয়া।
ঢাকা থেকে ‘পর্যটক এক্সপ্রেস’ ছাড়ার সময় সকাল সোয়া ছয়টা। সে কারণে কাক ডেকে ওঠার আগেই আমরা পৌঁছে গেছি কমলাপুর স্টেশনে। অনেক দিন পর সাতসকালে পথে নেমে মনে হলো—যে কোনো দিন ভোরে ওঠেনি, সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
কমলাপুর স্টেশনে আজ ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। তারপরও স্টেশনটার পরিবেশ ভালোই লাগল। পুরোনো জিনিসের প্রতি আমার মায়া একটু বেশি। এই স্টেশনটার প্রতিও সে রকম টান। স্টেশনটা যেন আমার আগের জন্মের বাড়ি। সেই যে ‘সোনার কেল্লা’-র মুকুল তার গত জন্মের বাড়ি খুঁজে পেয়ে বলেছিল—‘এটা গিরিধারীর বাড়ি, ওটা রতনদের। এখানে আমরা দোল খেলতাম।’
শেষবার যখন কমলাপুর স্টেশনে এসেছিলাম, এক অন্ধ জুটিকে দেখেছিলাম, গান গেয়ে ভিক্ষা করছেন। সম্ভবত দম্পতিই হবেন তাঁরা। এক হাতে লাঠি, আরেক হাত সঙ্গীর দেহ ছুঁয়ে। কখনো কখনো অন্ধ ধরে থাকে অন্ধতরের হাত। সঙ্গে ভাঙা গলায় উথালপাতাল গান—‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে…।’
ঈদের ট্রেন দেরি হবেই, তাই আমাদের কোনো তাড়া নেই। কিন্তু ট্রেন ঠিকই ছেড়ে দিল সময় ধরে। আস্তে আস্তে গতিও বাড়ল। ট্রেনের বাইরে তাকিয়ে দেখি, দুধারে বুনো ফুলগাছ দুলছে, হাওয়া বইছে হু হু করে। যেতে যেতে একটার পর একটা মাঠের সঙ্গে দেখা—দিগন্তলীন মাঠ। আরও খানিকটা এগোতে থাকি। দূরে খালি গায়ে মিলিয়ে যাচ্ছে একজন লোক। হাজার বছর আগে ওই পথ ধরে কোনো এক বাউল হেঁটে যেতেন। আমি যেন তাঁর সঙ্গে হেঁটে চলেছি!
হঠাৎ খেয়াল হলো, দুপুরের আলো মরে আসছে। আমরা পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। কক্সবাজারের এই স্টেশনটা ভারি সুন্দর, যেন সাগর থেকে ঝিনুক তুলে এনে বেলাভূমে বসিয়ে দিয়েছে। যাত্রীরা যাঁরা ট্রেন থেকে নামছেন, সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠছেন ছবি তুলতে। কেউ ছবি তুলছেন ঝিনুক প্রতিকৃতির সঙ্গে, কেউ স্টেশনের। হাওয়ার সঙ্গে, রোদের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গেও ছবি তুলছে মানুষ।
আমাদের ছোটবেলায় ছবি তোলা ছিল শিল্প। আর এখন প্রায় সন্ত্রাস। সাংবাদিকতা জীবনে বেশ কয়েকজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আমার সহকর্মী ছিলেন। তাঁদের দেখতাম প্রিন্ট করা ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন, মনে হতো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর এখন নিখরচায় ছবি উঠছে, সবাই এখন ফটোগ্রাফার।
ছবি তোলার এই হিড়িক থেকে আমরা বোধ হয় কেউই মুক্ত নই, হয়তো আমিও না। আসলে ফেসবুক না থাকলে জানতামই না, পৃথিবী নামের এই গ্রহে এত সুখ থইথই করে।
আচ্ছা, এই যে জোড়ায় জোড়ায় লোকে ছবি তুলছে আর সমাজমাধ্যমে চালিয়ে দিচ্ছে, এসব কি শুধু সুখের জন্য করছে? তারা কি সবাই সুখী? অসুখীও আছে ঢের। কতজন হয়তো স্রেফ সম্পর্কের মরদেহ বয়ে চলেছেন। কে কার খবর রাখে!
শীর্ষেন্দু লিখেছিলেন, ‘বাঙালির সবচেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার হলো প্রেম করা। আর সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট হলো বিয়ে করা।’ তবে যাঁরা বিয়ে করেননি, তাঁরা কখনো বলবেন না, ‘একসঙ্গে থাকার পঁচিশ বছর হলো।’ আমরা কিন্তু ঠিকই বলতে পারব। কারণ, আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকীর দিন।
আজ থেকে সিকি শতাব্দী আগে এই শহর-সৈকতে আমরা এসেছিলাম হানিমুনে। তারপর বহুবার কক্সবাজার ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’।
আজ এত বছর পর সেই সব স্মৃতি হাতড়াতে ফিরে এলাম কক্সবাজারে। আর বলতে এলাম, হে মহাসাগর, সফেন জলরাশি, হে প্রভু সাগরদেব- তোমার কাছে আছে আমার ভালোবাসার ঋণ।
লেখাটা শেষ করার আগে আর একটু বলি, আপনারা যাঁরা কষ্ট করে এতটা সময় নষ্ট করলেন, তাঁরা কিন্তু আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাতেই পারেন। তাতে যদি ‘জীবনপাত্র উছলিয়া’ ওঠে—ক্ষতি কি ভাই?
ভালো থাকুন। ঈদ মোবারক।
লেখক: কামরুল হাসানের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া সিনিয়র সাংবাদিক, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা