
বিশেষ প্রতিনিধি, সাতক্ষীরা থেকে ফিরে:
নবগঠিত সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির ৩১ সদস্য বিশিষ্ট্য পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি আগামী সাত এপ্রিল সোমবার নিজেদের মধ্যে প্রথমবারের মতো সভা করতে যাচ্ছে। শহরের পৌর ভবনে এই বিশেষ জরুরি সভা হতে যাচ্ছে। জেলা সম্মেলনের লক্ষে গঠিত পূর্ণাঙ্গ আহবায়ক কমিটির সদস্য সচিব আবু জাহিদ ডাবলু এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র বলছে, নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। অভিযোগ উঠেছে, নতুন কমিটিতে বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। অপেক্ষাকৃত জুনিয়রদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন দলে নিষ্ক্রিয় ছিলেন- বিগত আন্দোলন- সংগ্রামে মাঠে ছিলেন না- ৫ আগস্টের পরে নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন, এমন নেতাদের কাউকে কাউকে নবগঠিত কমিটিতে পদায়ন করা হয়েছে। লন্ডন প্রবাসী নেতাও নব গঠিত আহবায়ক কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন।
গত ২৪ মার্চ এইচ.এম রহমাতুল্লাহ পলাশকে আহ্বায়ক ও আবু জাহিদ ডাবলুকে সদস্য সচিব করে জেলা বিএনপির ৩১ সদস্য বিশিষ্ট্য পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারী ইফতেখার আলি ও আলিম চেয়ারম্যানের নেতৃত্বাধীন কমিটি নানা অভিযোগে বিলুপ্ত করে এইচ এম রহমতুল্লাহ পলাশকে আহবায়ক, আবু জাহিদ ডাবলুকে সদস্য সচিব করে ছয় সদস্যের আংশিক কমিটি করা হয়। যা পরে ৩১ সদস্যে রুপান্তরিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটিতে অন্যান্য যারা আছেন তারা হলেন, যুগ্ম আহবায়ক আবুল হাসান হাদী, তাজকিন আহমেদ চিশতি, ড. মনিরুজ্জামান, আখতারুল ইসলাম, সদস্য এড. সৈয়দ ইফতেখার আলী, আব্দুল আলিম, হাবিবুর রহমান হাবিব, শেখ তারিকুল হাসান, মাস্টার আব্দুল ওয়াহেদ, অধ্যক্ষ রইচ উদ্দিন, মোঃ আব্দুর রশিদ, স.ম হেদায়েতুল্লাহ, জি এম লিয়াকত আলী, শেখ সিরাজুল ইসলাম, শেখ এবাদুল ইসলাম, মৃণাল কান্তি রায়, মহিউদ্দীন সিদ্দিকী, শের আলী, সোলাইমান কবির, অধ্যক্ষ শফিকুল ইসলাম, শেখ মাসুম বিল্লাহ শাহীন, আব্দুর রকিব মোল্লা, ইঞ্জি: মোঃ আইয়ুব হোসেন, এড. নুরুল ইসলাম, ইব্রাহিম হোসেন, আশেক এলাহী মুন্না, আশরাফুর রহমান তুহিন, অধ্যাপক আতাউর রহমান ও মোঃ নুরুজ্জামান।
এদিকে, নবগঠিত আহবায়ক কমিটিতে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতারা লাইমলাইটে থাকায় সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ বেশ ক্ষুব্ধ। তারা অনেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। দলে সক্রিয় থাকবেন কিনা সেটা নিয়েও ভাবছেন কেউ কেউ। সূত্র বলছে, নবগঠিত কমিটির সদস্য সচিব আবু জাহিদ ডাবলুর উত্থানও মেনে নিতে পারেন নি অনেকেই।
সদস্য সচিব হবার আগে ডাবলু জেলা যুবদলের সভাপতি ছিলেন। তার আগে কৃষক দল করেছেন। ডাবলু রাজপথে, আন্দোলনে সক্রিয় নেতা” এই কথা সবাই স্বীকার করলেও অভিযোগকারীরা বলেছেন, ডাবলু কোন সময় মূল দলের দায়িত্বে ছিলেন না। অঙ্গ সংগঠনের নেতা থাকা অবস্থায় মূল দলের সদস্য সচিব হওয়াটাকে সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ ভালো চোখে নেননি। তারা রীতিমতো বিব্রত বোধ করছেন। ডাবলুর নেতৃত্ব কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছেন সবাই।
এই বিষয়ে আলাপকালে ক্লিন ইমেজের অধিকারী, এবার নিয়ে চার চারবার জেলার শীর্ষ পদে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রীধারী, চিরতরুণ রাহমতুল্লাহ পলাশ অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় ডটকমকে বলেছেন, আমরা বর্তমান ৬ সদস্যের আহবায়ক কমিটিকে ৩১ সদস্য করেছি। সাবেক কমিটির চারজন ও সাত উপজেলা থেকে দুইজন করে নিয়েছি। কৌশলগত কারণে করা হয়েছে, এমন মন্তব্য প্রয়াত সাবেক মন্ত্রীর সন্তান রহমতুল্লাহ পলাশের।
সূত্র বলছে, বিএনপির সাতক্ষীরা জেলার সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা, তালা, কলারোয়া, আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ উপজেলা মিলিয়ে ৭ উপজেলা। সাতক্ষীরা, কলারোয়া ও শ্যমনগর মিলে ৩ পৌরসভা, ৩ পৌরসভায় ৯ টি করে ২৭ টি পৌর ওয়ার্ড কমিটি, আবার ৭৭ টি ইউনিয়ন কমিটি, একইভাবে প্রত্যেকটি ইউনিয়নে ৯ টি করে ৬৯৩ টি ইউনিয়ন কমিটি- সব মিলিয়ে জেলার ৮০৭ টি কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারি একযোগে বিলুপ্ত করা হয়।
বিলুপ্ত ঘোষিত কমিটিগুলো নতুন করে গঠন করে আগামী তিন মাসের মধ্যে জেলা সম্মেলনের টার্গেট এখন আমাদের। রহমতুল্লাহ পলাশ জানান, সবার সহযোগিতায় দলকে ব্যাপকভাবে ঢেলে সাজানো হবে। আলাপকালে তিনি আরও জানান, সাতক্ষীরা জেলার সর্বত্র দক্ষ, ক্লিন ইমেজের সংগঠক, দলের ত্যাগী নেতাদের সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত কমিটিতে আনা হবে। কোন মাই ম্যান সিস্টেমে কমিটি বা পকেট কমিটি হবে না। সব জায়গাতেই ভোটে কমিটি হবে- এমনটি জানান তিনি।
এর আগে ইফতেখার আহমদের নেতৃত্বাধীন জেলা বিএনপির কমিটি তিন মাসের জন্য তৈরি হলেও পাঁচ বছরেও জেলা সম্মেলন করতে না পারায় দলের হাই কমান্ড সেই কমিটি গত ৬ ফেব্রুয়ারিতে নানা অভিযোগে ভেঙে দেয়। জানা গেছে, জেলা কমিটিসহ সব উপজেলায় কমিটি নিয়ে গ্রুপিং ছিলো ওপেন সিক্রেট। কমিটি করতে গিয়ে একাধিক উপজেলায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া, এমনকি ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি হয়েছে।
আগের কমিটিতে যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন এমন দুই ত্যাগী নেতা নতুন কমিটিতে সদস্য হয়েছেন। সাবেক কমিটির নির্লিপ্ততায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিশেষ অনুরোধে ২০২৩ এর ২৮ অক্টোবরের পরে দলের হাল ধরেছিলেন সাবেক কমিটির যুগ্ম আহবায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব।
জানা গেছে, তিনি দীর্ঘদিন দলে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছিলেন। হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত দলের অধিকাংশ নেতার অনুপস্থিতিতে তিনি একাই দলের হাল ধরে রেখেছিলেন। দলের ক্রাইসিসে হাবিব ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসাবে দল চালিয়েছেন। নতুন কমিটিতে বর্ষিয়ান নেতা হাবিব আগের যুগ্ম আহবায়ক পদ ফিরে পান নি, পেয়েছেন সদস্য পদ।
নিজ বাসভবনে আলাপকালে দলের এই ত্যাগী নেতা হাবিব বলেছেন, তাকে অবমুল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমান কমিটিতে সদস্য সচিব পদ প্রত্যাশি হাবিব আলাপকালে আরও বলেছেন, তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়ররা এখন লাইম লাইটে। এটা খুবই অবমাননাকর। একই অবস্থা দলের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক তরিকুল হাসানের। নতুন কমিটিতে তিনিও সদস্য পদ পেয়েছেন। দলে তার অনেক জুনিয়র নেতা এখন পদাধিকারবলে তার সিনিয়র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র বলছে, এই কমিটিতে সাবেক আহবায়ক কমিটির দুই প্রভাবশালী নেতার অন্তর্ভুক্তকে ভালো চোখে নেয় নি অধিকাংশ নেতা-কর্মীরা।
সূত্রমতে, সাতক্ষীরা বিএনপির ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে কমিটি ছিলো আগের কমিটি। যেখানে কোন শৃঙ্খলা ছিলনা। গ্রুপিং ছিলো শীর্ষে। জেলা থেকে উপজেলা বা ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যন্ত গ্রুপিং ছিলো নজিরবিহীন। কমিটি- পাল্টা কমিটি কিংবা কমিটি করতে গিয়ে দাঙ্গা- হাঙ্গামা ছিলো নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা।
অভিযোগ আছে, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পরে এরশাদ জামানার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী কাজি জাফর স্টাইলে রাজনৈতিক অসুস্থ হয়ে সাবেক আহবায়ক কমিটির শীর্ষ দুই নেতা সাতক্ষীরা ছেড়ে ছিলেন। দীর্ঘ বিরতির পরে শেখ হাসিনার পতনের সময় তাদেরকে আবার সরব দেখা গেছে। বিষয়টি সাতক্ষীরা বিএনপিতে ওপেন সিক্রেট।
সূত্র বলছে, নব গঠিত বর্তমান কমিটির অন্তত তিনজন যুগ্ন আহবায়ক রয়েছেন, যারা দলে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয়। লন্ডনে আছেন এমন ব্যক্তিও নতুন আহবায়ক কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন। অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতারা সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। জেলার একটি উপজেলা থেকে অধিকমাত্রায় পদে আসার সুযোগ পেয়েছেন। দলে আন্দোলন, সংগ্রাম বা অতীতে রাজপথে ছিলেন না, এমন নেতারাও এখন ফ্রন্ট লাইনে। অভিযোগ আছে, ৫ জানুয়ারির পর সক্রিয় এমন নেতারাও জেলার নবগঠিত আহবায়ক কমিটিতে এখন বেশ সোচ্চার।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবু জাহিদ ডাবলু এসব বিষয় নিয়ে বলেছেন, শুনেছি, কেউ কেউ মনোকষ্ট, বেদনা নিয়ে আছেন, এটা দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। কমিটিতে নানা অনিয়ম ও অভিযোগ প্রসঙ্গে ডাবলু জানান, কেন্দ্র থেকে কমিটি করা হয়েছে।
সাবেক মন্ত্রী আমানউল্লাহ আমান সাতক্ষীরার দায়িত্বে আছেন। দলের খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বে অমিত, জয়ন্ত কুন্ড আছেন। তারা দেখভাল করে কমিটি দিয়েছেন। ফাইনালি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেখেছেন। সেক্ষেত্রে কমিটি গঠনে আমাদের কোন হাত ছিলো না।
কে প্রমোশন পেয়েছেন, কে পাননি, সব কিছুই কেন্দ্র থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ ডাবলু আরও জানান, ক্ষোভ বা বেদনা যাই থাকুক, সেটা মনে মনে আছে, এসবের বহিঃপ্রকাশ নেই। আমরা দ্রুত ঠিক করার চেষ্টা করছি।