
অনলাইন ডেস্কঃ
পহেলা বৈশাখ ঘিরে রাজধানীসহ গোটা দেশের বাজারগুলোতে বেড়ে যায় ইলিশের বেচাকেনা। বৈশাখের চাহিদাকে পুঁজি করে সামুদ্রিক মাছটি বিক্রি হয় চড়া দামে। বিক্রেতাদের দাবি, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে বাজারে দেখা যায় ইলিশের অস্বাভাবিক চাহিদা। এর ক্রেতাদের দাবি এই সুযোগকে প্রতিবারই কাজে লাগাই অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর তখনই সাধারণের ধরাছোঁয়ার অনেকটা বাইরে চলে যায় বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ।
বর্তমানে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১,৮০০-২,০০০ টাকায়। এছাড়া দেড় কেজি ওজনের ইলিশ ২,৫০০ টাকায়। এসব সাধারণের এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তাদের অনেকের ভরসা ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ। তবে জাতীয় মাছ বলে কথা। এই ছোট্ট ইলিশের প্রতি কেজির জন্য গুনতে হচ্ছে ১,২০০-১,৪০০ টাকা।
ইলিশের পুষ্টিমান বনাম অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ: ইলিশের পুষ্টিমান অনেক কমদামি সামুদ্রিক মাছের সমান, কিছু ক্ষেত্রে কমও বটে। ইলিশে উচ্চমাত্রায় থাকে মানুষের শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। এই বিশেষ ফ্যাটি অ্যাসিড বিশেষভাবে হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়ক এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। একই মাত্রায় অতি প্রয়োজনীয় এই ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে অতি সাধারণ সামুদ্রিক মাছ ম্যাকারেলে যা সাধারণত সারাবছরই বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।
ইলিশের চেয়ে উচ্চ মাত্রায় আমিষ বা প্রোটিন পাওয়া যায় টুনা মাছে। এই প্রোটিন শরীরের কোষ গঠন, মাংসপেশির উন্নয়ন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশে ২১-২৩ শতাংশ প্রোটিন থাকে। সমপরিমাণ টুনায় থাকে ২৪-২৮ শতাংশ প্রোটিন। ম্যাকারেল পাওয়া আমিষের পরিমাণ ইলিশের চেয়ে মাত্র এক শতাংশ কম। অন্যদিকে, ইলিশের সমান উচ্চ মাত্রায় চর্বি বা ফ্যাট থাকে ম্যাকারেলে।
ইলিশে ভিটামিন এ, ডি, বি থাকে। এছাড়া সেলেনিয়াম, আয়রন এবং ফসফরাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ খনিজ (মিনারেল) থাকে। এদিকে, দেখতে অনেকটা ইলিশের মতো সস্তা মাছ সার্ডিনেও ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়ামের প্রাচুর্যে থাকে। ম্যাকারেল মাছে ভিটামিন বি, ডি পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। এছাড়া মিনারেল বা খনিজ লবন হিসেবে থাকে পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম।
ইলিশ চর্বি বা ফ্যাটযুক্ত মাছ, যাতে স্বাস্থ্যকর মনোআনস্যাচুরেটেড এবং পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। অন্যান্য চর্বিযুক্ত মাছ যেমন স্যামন বা ম্যাকারেলেও উচ্চমাত্রায় ফ্যাটের উপস্থিতি থাকে।
ইলিশের তুলনায় অন্যন্য সামুদ্রিক মাছের দাম:বাংলাদেশে ইলিশের দাম অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের তুলনায় অনেক বেশি। মূলত মাছটির স্বাদ এবং সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্যগত গুরুত্বের কারণে এর চাহিদা এবং দাম বেশি হয়। আনুমানিক এক কিলোগ্রাম ওজনের প্রতিটি ইলিশের দাম হয়ে থাকে ১,৮০০ – ২,৫০০ টাকা যা আকার ও মৌসুমভেদে উঠানামা করে।
অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ যেমন এক কেজি ওজনের ম্যাকরেল মাছের দাম ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা হয়ে থাকে। সারাবছর ধরেই এক কেজি ওজনের টুনা মাছ বাজারে পাওয়া যায় ৫০০–৮০০ টাকায়। ইলিশের তুলনায় এই দুই প্রজাতির মাছ অনেক সহজলভ্য এবং সস্তা।
এছাড়া, সুস্বাদু রূপচাঁদার দাম কেজিপ্রতি ৬০০– ১,২০০ টাকা হয়ে থাকে। বড় আকারের গলদা চিংড়ি সারাবছর কেজি প্রতি ৮০০– ১,৫০০ টাকায় পাওয়া যায়।
ইলিশের দাম অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি। তবে ম্যাকরেল, টুনা, রূপচাঁদা, সুরমা, লবস্টারের মতো অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ ইলিশের চেয়ে পুষ্টিগুণ কম না হলেও অনেক সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্রেতার এমন ইলিশ-আসক্তির কারণে সামুদ্রিক এই মাছটির দর গত ১৫ বছরে বেড়েছে ছয় গুণের বেশি। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে ২০১১ সালে এক কেজি ওজনের একটি ইলিশ কেনা যেত ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। একই ওজনের একটি মাছ কিনতে এখন গুণতে হচ্ছে ২০০০ থেকে ২ হাজার ২শ’ টাকা।
ইলিশ কি শুধু স্বাদের জন্যই আকাশচুম্বী: খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা এবং দাম নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে স্বাদ। যদিও পুষ্টিমান এ ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। সুস্বাদু মাছ বা ফলের স্বাদ ও দাম নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অনেক ক্রেতার কাছে শুধুমাত্র স্বাদই বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। মাছ, মাংশ, ফলসহ অধিকাংশ খাবার কিনতে ক্রেতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এর ভেতরকার স্বাদ ও ঘ্রাণ।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ইলিশ যা কিনা শুধুমাত্র এর অনন্য স্বাদ এবং সুঘ্রাণের কারণে দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। উৎসব-পার্বনে ভারতের বাংলাভাষী মানুষের কাছেও ইলিশ খুবই আকর্ষনীয় মাছ। একইভাবে, মৌসুমি ফল যেমন আমের বিশেষ কিছু জাতের দামও এর সুমিষ্টতা এবং স্বাদ-ঘ্রাণ-রঙের কারণে বেশি হয়। কিন্তু পুষ্টিবিদরা মনে করেন, এসব বেশি পরিমাণে থাকার মানেই যে এর পুষ্টিমান বেশি, তা সত্য নয়।
সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ইলিশের আকাশচুম্বী দামের মূল কারণ হলো এর স্বাদ এবং জনপ্রিয়তা। তবে অন্যান্য অনেক মাছ আছে যেগুলোর পুষ্টিগত মান খুবই ভালো কিন্তু দাম তুলনামূলকভাবে কম। ফলের ক্ষেত্রেও একই ধরনের উদাহরণ দেখা যায়, একটি ফল স্বাদে খুব ভালো হলেও, পুষ্টিগুণে তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে।
ক্রেতার মানসিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা সাধারণত স্বাদের জন্যই বেশি অর্থ দিতে প্রস্তুত থাকে। তবে পুষ্টিগুণের দিক থেকে যারা সচেতন, তারা হয়তো খাদ্যমানকেও মূল্যায়ন করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ভোক্তাই স্বাদের জন্যই বেশি অর্থ খরচ করতে রাজি থাকেন।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভোক্তারা যখন বাজারে কেনাকাটা করেন, তখন তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় স্বাদ এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে, পুষ্টিগুণ নিয়ে খুব বেশি ভাবেন না। স্বাদ অনেক ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্য সব কিছুর চেয়ে এগিয়ে থাকে।
অনেক পুষ্টিবিদের মতে, কিছু মাছ বা ফল স্বাদে বেশি হলেও পুষ্টিমানে সবসময় এগিয়ে থাকে না। অধিকাংশ ক্রেতাই সাধারণত স্বাদের জন্য বেশি অর্থ খরচ করতে ইচ্ছুক, যদিও স্বাস্থ্যের দিক থেকে যারা সচেতন তারা খাদ্যমানের দিকেও নজর দেন।