
অনলাইন ডেস্কঃ
মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে নগর ভবন অবরুদ্ধ করে রাখা ইশরাক হোসেন স্বেচ্ছায় সরে না গেলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের দিকে এগোবে সরকার।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় উপদেষ্টা পরিষদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। সভায় বিএনপিকে এই বার্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উপদেষ্টা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে বৈঠকে ৯ জন উপদেষ্টা অংশ নিয়েছেন। সভায় নগর ভবন অচল করায় উপদেষ্টারা ইশরাকের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন। একাধিক উপদেষ্টা সরকারপ্রধানকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন।
ইশরাকে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ সরকার
গতকালের বৈঠকে অর্থ, পরিকল্পনা, আইন, শিল্প, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, স্থানীয় সরকার, সংস্কৃতি উপদেষ্টাসহ ৯ জন অংশ নেন। একাধিক উপদেষ্টা বলেন, শপথ না নিয়েই মেয়রের ‘দায়িত্ব’ পালন করায় ইশরাকের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। রোববার এ বিষয়ে আরও আলোচনা হতে পারে। কারণ, নাগরিকদের ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা বিষয়টি দ্রুত সমাধান করতে বলেছেন। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টাসহ সবাই বিরক্তি প্রকাশ করেন।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস জয়ী হন। তখন কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল বাতিলের দাবি জানিয়ে মামলা করেন বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন। গত ২৭ মার্চ ঢাকার নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ইশরাক হোসেনকে নির্বাচিত ঘোষণা করে।
গত ২২ এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ে পরামর্শ চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরামর্শ পাওয়ার আগেই ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে ইসি। আইন অনুযায়ী গেজেটের ৩০ দিনের মধ্যে শপথ পাঠ করানোর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের।
মন্ত্রণালয় তখন জানায়, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, মামলা দায়েরের পর আর্জি সংশোধনের সুযোগ নেই। কিন্তু ইশরাক গত বছরের সেপ্টেম্বরে তা করেছেন এবং ফল বাতিল নয়, তাঁকে জয়ী ঘোষণা করার আবেদন করেছেন।
ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের সমালোচনা করে এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দাবি করে, শেখ হাসিনার শাসনামলের অবৈধ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে এর মাধ্যমে।
শপথ নিতে না পেরে ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা ‘ঢাকাবাসী’র ব্যানারে গত ১৪ মে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নেন এবং বিভিন্ন কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন। তখন থেকেই সব নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। উপদেষ্টা, কর্মকর্তারাও নগর ভবনে প্রবেশ করতে পারছেন না। এরপর ইশরাক সমর্থকরা প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ঘেরাও করে রাখেন তিন দিন। ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে জারি করা গেজেট বাতিল চেয়ে রিট হয়। হাইকোর্টের পর আপিল বিভাগও তা খারিজ করে দেন।
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গঠিত সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১ জুন। এরপরও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ইশরাক। গত সোমবার তিনি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে নগর ভবনে সভা করেন। তাঁর পেছনে টানানো ব্যানারে লেখা ছিল ‘মাননীয় মেয়র’। পরের দু’দিনও সভা করেন ইশরাক। অবশ্য গতকাল বৃহস্পতিবার নগর ভবনে যাননি তিনি।
এ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল প্রশ্ন তুলে বলেছে, যে সরকার একটি ভবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারা কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করবে। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। একাধিক উপদেষ্টা বলছেন, সরকারের কর্তৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
বৈঠক শেষে কয়েকজন উপদেষ্টা বলেন, ইশরাক হোসেন সিটি করপোরেশনে তালা দিয়ে কর্মচারীদের কাজে বাধা এবং মেয়রের চেয়ারে বসে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তারা এই বিষয়টির সুরাহা চান।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে নগর ভবন সচল করার পরামর্শ আসে বৈঠকে। তবে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর দলটির সঙ্গে যে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট হবে আশঙ্কায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহারের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি বলে সূত্র জানায়।
একাধিক উপদেষ্টা বলেন, অবৈধ আখ্যা দেওয়া নির্বাচনের মেয়র হতে চেয়ে নগর ভবন অবরুদ্ধ করে রেখে তিনি ইতোমধ্যে সমালোচিত ও বিতর্কিত হয়েছেন। এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করলে ইশরাক সহানুভূতি পাবেন।
একাধিক উপদেষ্টা সমকালকে জানান, বৈঠকের এ পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, সরকার বিএনপিকে একটি বার্তা দেবে। তা হলো–ইশরাক যদি নগর ভবনে বিশৃঙ্খলা বন্ধ না করেন, তবে সরকার স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের দিকে এগোবে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাইছে।
আর চুপ থাকার মতো পরিস্থিতি নেই– আসিফ
গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষ থেকে উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে নির্মাণ করা গণগ্রন্থাগারের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। বৈঠকের পর সচিবালয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিষয়ে তিনি বলন, আসলে আর চুপ থাকার মতো পরিস্থিতি নেই।
উপদেষ্টা বলেন, সরকার বিষয়টি জানে। তাই মন্ত্রণালয়ের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নেই। সরকারে আমরা সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আমরা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার কথা বলি। আর তা রক্ষা করতে গেলে প্রত্যেকের কাছ থেকেই দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশিত।
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তবে আমরা যতটা সম্ভব, বাইরে থেকে হলেও নাগরিক সেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, মেয়রের ইস্যুতে সরকার, বিএনপি ও ইশরাক সবাই বাড়াবাড়ি করেছে। আইন অনুযায়ী ইশরাকের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই। তবে সব পক্ষ একমত হলে ইশরাক হোসেনকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। তিনি বলেন, ইশরাক অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে ‘মেয়রের দায়িত্ব পালন’ শুরু করছেন; এটি সমীচীন নয়। খারাপ নজির স্থাপন করা হচ্ছে। বড় দল হিসেবে বিএনপিরও এটা দেখার দায়িত্ব আছে।