
অনলাইন ডেস্কঃ
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছে বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি। ইসিতে জমা দেওয়া আবেদনে দলের কার্যালয়ের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকার মগবাজার ৬৩৯/বি, পেয়ারাবাগ। মঙ্গলবার বিকেলে এ ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ দেয়ালের ওপরে টিনের ছাউনির এক কক্ষের একটি ছোট্ট ঘর।
ঘরে কেউ আছেন—অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া গেল না। পরে দলের সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হাওলাদারের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করেন প্রতিবেদক। ফোন ধরেন এক নারী। তিনি নিজেকে জাহাঙ্গীর হাওলাদারের স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা বলে পরিচয় দেন। তাঁর স্বামী বাসায় আছেন বলে জানান। এরপর ঘরের দরজা খুলে গায়ে গামছা জড়িয়ে বেরিয়ে আসেন বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টির সভাপতি জাহাঙ্গীর হাওলাদার।
রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, ‘নিবন্ধনের জন্য আবেদন সাবমিট করছি আরকি। ২০১১ সালে পার্টিটা গঠন করছি। আমি যখন তিতুমীর কলেজে পড়ালেখা করি তখন আরকি। এখানে অফিস নেব চিন্তা করছি আরকি। আগে দলটল ঠিক অইলে এর পরে নেব আরকি।’
দলের কোনো কমিটি আছে কি না, জনতে চাইলে জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, ৭৫ সদস্যের কমিটি আছে। এ কমিটিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের লোকজন আছে। দলের সাধারণ সম্পাদক এখন কে—জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, তাঁর স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা আপাতত দলের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নিজের ভাড়া বাসাকেই আপাতত দলের কার্যালয়ের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করার কথা জানান বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টির এই সভাপতি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ-তিসারী-ইনসাফ দল তাদের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেছে একটি রেস্তোরাঁকে। ইসির নিবন্ধন আবেদনে দলটির ঠিকানা ৫৪ পুরানা পল্টন, বি কে টাওয়ার। গতকাল এ ঠিকানায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। ৫৪ নম্বর বাড়িটি তিনতলা। বেশ কিছু দিন ধরে তৃতীয় তলায় কেউ থাকছে না। দ্বিতীয় তলায় ‘ভোজন রেস্তোরাঁ’ নামে খাবারের হোটেল ছিল। এটিও গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বন্ধ রয়েছে। আর নিচতলায় ‘মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘর’ নামে একটি হোটেল চালু আছে।
এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মো. মিনহাজ প্রধানের নাম ইসিতে করা নিবন্ধন আবেদনে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তাঁর মুঠোফোন নম্বরও লেখা আছে। এ নম্বরে যোগাযোগ করে হলে তিনি বলেন, ভবনটির ওপরের তলাগুলোতে সংস্কারকাজ চলমান। অফিসকক্ষেরও সংস্কার চলছে। অফিসকক্ষ কত তলায়—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তৃতীয় তলায়। কিন্তু তৃতীয় তলা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে—এমন প্রশ্ন করার পর তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত মুসলিম হোটেলে বসি।’
পরে মুসলিম হোটেল অ্যান্ড কাবাব ঘরের ম্যানেজার (ব্যবস্থাপক) মো. সোহাগের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তিনি বলেন, মিনহাজ প্রধান এখানে প্রায়ই আসেন নাশতা খেতেন। রাজনীতি বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু তাঁদের হোটেল কোনো দলের কার্যালয় নয়। মিনহাজ প্রধান কোনো দলের নেতা কি না, সেটি তাঁর জানা নেই। আর ভবনটিতে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ও নেই।
মিনহাজ প্রধানের বাংলাদেশ-তিসারী-ইনসাফসহ মোট ১৪৭টি দল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত হওয়ার জন্য আবেদন করেছে। গত রোববার শেষ দিনে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা দলীয় প্রতীক হিসেবে জাতীয় ফুল ‘শাপলা’ চেয়েছে। এ ছাড়া এনসিপির পছন্দের প্রতীকের তালিকায় আরও দুটি প্রতীক রয়েছে। এর একটি ‘কলম’ অন্যটি ‘মোবাইল’। এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয় বাংলামটরের রূপায়ণ টাওয়ারে।
যেসব দল ইসির নিবন্ধন পাবে, তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীকে ভোট করতে পারবে। এখন ইসিতে নিবন্ধিত দল আছে ৫১টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে।
নতুন দলের ক্ষেত্রে ইসিতে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য দলের সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং কার্যকর কমিটি থাকতে হয় কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায়। পাশাপাশি সদস্য হিসেবে অন্তত ১০০টি উপজেলা কিংবা মেট্রোপলিটন থানার কমপক্ষে ২০০ ভোটারের সমর্থনের নথিও দেখাতে হয়।
ইসিতে নিবন্ধন পেতে আবেদন করা দলগুলোর মধ্যে গতকাল ৩৪টির কার্যালয়ে গেছেন প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক ও আটজন প্রতিনিধি। এর মধ্যে ২৬টি দলের কার্যালয় রাজধানী ঢাকায়। বাকি আটটি দলের কার্যালয় হিসেবে নিবন্ধন আবেদনে খুলনা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, বান্দরবান, গাইবান্ধা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও সাভারের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি দলের ঠিকানায় গিয়ে কোনো সাইনবোর্ডও দেখা যায়নি। এসব ঠিকানার কোনোটি ছিল বাড়ি, কোনোটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। গাজীপুরে বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টির (বিআরপি) ঠিকানায় গিয়ে অবশ্য সাইনবোর্ড দেখা গেছে। তবে কার্যালয় বন্ধ পাওয়া যায়।
ইসিতে যেসব দল নিবন্ধনের আবেদন করেছে, সেগুলোর মধ্যে তিনটি দলের নামে ‘বেকার’ শব্দ রয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস) ও বাংলাদেশ বেকার সমাজ।
এই তিন দলের মধ্যে ইসিতে নিবন্ধনের জন্য করা আবেদনে বাংলাদেশ বেকার সমাজের (বাবেস) ঠিকানা উল্লেখ করেছে ‘১৩১/১/এ, ক্রিসেন্ট রোড (ধানমন্ডি)। গতকাল দুপুরে ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চারতলা একটি আবাসিক ভবন রয়েছে। ভবনের প্রবেশপথের বাঁ পাশে বাবেসের সাইনবোর্ড রয়েছে। এ ভবনের তৃতীয় তলায় দলটির কার্যালয়। যেটি একই সঙ্গে দলের সভাপতি মো. হাসানের ছেলের বাসা। দরজায় কড়া নাড়তেই বেরিয়ে এলেন নাদিয়া খানম নামের এক নারী। তিনি নিজেকে মো. হাসানের পূত্রবধু হিসেবে পরিচয় দেন। এ বাসার ড্রয়িংরুম (বসার ঘরে) দলের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করার কথা জানান তিনি।
পরে বাবেসের সভাপতি মো. হাসানের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। তিনি বলেন, দলটি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি কয়েকবার বিভিন্ন আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। তাঁর দল বেকার সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে।
ছেলের বাসায় দলীয় কার্যালয়ের বিষয়ে মো. হাসান বলেন, ‘বড় কয়েকটি দল ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো দলেরই সেভাবে কার্যালয় নেই। বাসাটিতে আমরা অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছি। পাশের কক্ষে ছেলে ও পূত্রবধু থাকে।’
আজব সব নাম
ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা কয়েকটি দল হলো বাংলাদেশ বেস্ট পলিটিক্যাল পার্টি, নাকফুল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নাগরিক কমান্ড, বাংলাদেশ জনগণের দল, বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক প্রজন্ম, বাংলাদেশ সলুশন পার্টি, বাংলাদেশ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ জনগণের দল (বাজদ), জনতার কথা বলে, বাংলাদেশ শান্তির দল, বাংলাদেশ মাতৃভূমি দল, বাংলাদেশ পাক পাঞ্জাতন পার্টি (বিপিপি), বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ সর্ব-স্বেচ্ছা উন্নয়ন দল।
এ ছাড়া চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ও সাংবাদিক শওকত মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জনতা পার্টি বাংলাদেশ, ডেসটিনি গ্রুপের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টিও ইসির কাছে নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছে।
ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা আরেকটি দল হচ্ছে ‘Muslim Save Union’। দলটির কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া শান্তিনগর বাজারের ২ নম্বর লেনের রমজান ট্রেডিং-৮৩ (তৃতীয়, চতুর্থ তলা)। তবে গতকাল এ ঠিকানায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে দলটির সভাপতি আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, ওই ঠিকানায় আর কার্যালয় নেই। তাহলে এখন কার্যালয় কোথায়—জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিবাগের প্রশান্তি হাসপাতালের পাশে একটি বিল্ডিংয়ে আছে।
জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি নামে আরেকটি দল নয়াপল্টনের ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলাকে দলীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ ঠিকানায় ‘আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’সহ বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ইসিতে জমা দেওয়া আবেদনে এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে মো. কামরুজ্জামানের নাম উল্লেখ রয়েছে। আবেদনে উল্লেখ করা মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আগে তো সবকিছু সিস্টেম অনুযায়ী করতে হয়। সে জন্য আল আমিন ট্রাভেলসকে আমরা অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছি। নিবন্ধনের আবেদন করতে তাড়াতাড়ি এ ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অফিস নেব।’
পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডের প্রীতম জামান টাওয়ারে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের কার্যালয়। ভবনটির ১৫ তলার ওপরে ছাদের এক পাশে দুটি দলের কার্যালয়। এর একটি ন্যাশনাল লেবার পার্টি, অন্যটি জনতার অধিকার পার্টি। এই অধিকার পার্টির কক্ষকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’ নামের আরেকটি দল।
এই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে কে এম রকিবুল ইসলামের নাম উল্লেখ রয়েছে ইসির নিবন্ধন আবেদনে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা অধিকার পার্টির ওখানে একসঙ্গে আছি। আগে রুমের দরজায় দলের নামসহ স্টিকার ছিল। সেটা মনে হয় পড়ে গেছে। আমরা আবার স্টিকার লাগাব।’
সূত্র : প্রথম আলো