
অনলাইন ডেস্কঃ
আন্দোলন প্রত্যাহারের পর সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়। এ ছাড়া সাময়িক বরখাস্ত (সাসপেন্ড) হওয়ার ভয় ও প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তার পরামর্শে সংস্থাটির চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানের কাছে গণক্ষমা চান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কার্যত এসবে কোনো কাজ হলো না। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি, সহসভাপতিসহ কাস্টমস ও ট্যাক্সের একডজন ক্যাডার কর্মকর্তাকে গতকাল মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর বাইরে দুজন নন-ক্যাডার কর্মকর্তাকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রথম ধাপে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর পর এবার বদলির আদেশ ছেঁড়ার দায়ে একযোগে আয়করের ৯ ও কাস্টমসের তিন ক্যাডার কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শাস্তিমূলক এসব ব্যবস্থার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চলমান অনুসন্ধান তো আছেই। নতুন করে কমিশনার থেকে শুরু করে নন-ক্যাডারদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার গুঞ্জন রয়েছে। এতে বোর্ডের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ফের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহারের পর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান জানিয়েছিলেন, ঠিকমতো কাজ করলে কারও কোনো সমস্যা হবে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তির ভয় ও এনবিআরের প্রভাবশালী কিছু কর্মকর্তার চাপে কাস্টমস ও ট্যাক্সের কর্মকর্তারা ব্যাচ ধরে গণক্ষমা চান। অবশ্য গণক্ষমা প্রার্থনা ও গণমাধ্যমের সামনে দেওয়া এসব বক্তব্য কিছুতেই কিছু হলো না। কিছুদিনের ব্যবধানে সবশেষ আন্দোলনের জেরে কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের ১২ জন কর্মকর্তাকে গতকাল সাময়িক বরখাস্ত করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। নতুন করে শাস্তির আওতায় আসাদের মধ্যে রয়েছেন ঐক্য পরিষদের সভাপতি এবং ভ্যাট, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হাছান মুহাম্মদ তারেক রিকাবদার। সাময়িক বরখাস্তের তালিকায় রয়েছেন ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি কর অঞ্চল-৮-এর অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানাও। এর আগে আন্দোলন প্রত্যাহারের দিন এ দুই কর্মকর্তাসহ আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকা ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরুর তথ্য সংবাদ সম্মেলন করে জানায় দুদক। যদিও আন্দোলন দমাতে দুদককে ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবি অভিযোগ তোলার পর এনবিআর আর এই পথে এগোয়নি। তবে আন্দোলন প্রত্যাহার করে যখন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিচ্ছিলেন, তখন নতুন এত কর্মকর্তার সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন ফের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। এবারের শাস্তির তালিকায় নতুন করে যোগ হয়েছেন কাস্টমসের নন-ক্যাডারের দুই রাজস্ব কর্মকর্তা। যদিও আন্দোলন প্রত্যাহারের সময় সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।
এনবিআরের আন্দোলন প্রত্যাহারের অন্যতম মধ্যস্থতাকারী বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী সম্প্রতি জানিয়েছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এনবিআর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল নতুন করে বরখাস্ত হওয়াদের মধ্যে রয়েছেন কাস্টমসের দুজন অতিরিক্ত কমিশনার ও একজন উপকমিশনার। আর আয়কর ক্যাডারের পাঁচ যুগ্ম কর কমিশনার ও তিন উপ-কর কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের সবার বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিন এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২২ জুন জারি করা বদলির আদেশ অবজ্ঞাপূর্বক প্রকাশ্যে ছিঁড়ে ফেলার মাধ্যমে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করায় তাদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৩৯(১) ধারা অনুযায়ী, এনবিআরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপূর্বক চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন বিধি মোতাবেক খোরপোশ ভাতা প্রাপ্য হবেন তারা। নতুন করে বরখাস্ত হওয়া অন্য কর্মকর্তারা হলেন কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার সিফাত-ই-মরিয়ম, এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব ও উপকমিশনার সাহাদা জামিল, কর অঞ্চল-২-এর বিভাগীয় প্রতিনিধি (যুগ্ম কর কমিশনার) মাসুমা খাতুন, কর অঞ্চল-১৫-এর যুগ্ম কর কমিশনার মুরাদ আহমেদ, কুষ্টিয়া কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন খান, নোয়াখালী কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, কক্সবাজার কর অঞ্চলের যুগ্ম কর কমিশনার মো. আশরাফুল আলম প্রধান, খুলনা কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম, রংপুর কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার মোসা. নুশরাত জাহান শমী এবং কুমিল্লা কর অঞ্চলের উপ-কর কমিশনার ইমাম তৌহিদ হাসান শাকিল।
এর আগে গত ২ জুলাই এনবিআরের কর বিভাগের সদস্য মো. আলমগীর হোসেন, মূসক নীতির সদস্য ড. মো. আবদুর রউফ, শুল্কনীতির সদস্য হোসেন আহমদ ও বরিশালের কর কমিশনার মো. শব্বির আহমদকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। তার আগের দিন ১ জুলাই রাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। বরখাস্তের পর তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে এনবিআরে সংযুক্ত করা হয়।
জানা গেছে, চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তাদের বরখাস্তের গুঞ্জন ছিল। এ গুঞ্জনের বাস্তবিক রূপ প্রকাশ পায় গতকাল সকাল থেকে। এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান এবং কাস্টমসের দুই সদস্য ও আয়কর বিভাগের এক সদস্য সকাল ৮টার দিকে সচিবালয়ে প্রবেশ করেন। তখন থেকে এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে জানিয়েছেন, দু-তিন ধরে এনবিআর চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ আয়কর বিভাগের এক কর্মকর্তা সকাল-বিকেল কাস্টমসের একজন সদস্যের দপ্তরে আসা-যাওয়া শুরু এবং দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করেন। তখন থেকেই অনেকের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেয়, আসলে কী হচ্ছে। যার উত্তর মেলে গতকালের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে। আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা আরও শতাধিক ক্যাডার কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হতে পারে বলেও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।