
অনলাইন ডেস্কঃ
বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার শঙ্কা রয়েছে। আর এখন পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবিলায় কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
গত মে মাসে বাংলাদেশ সফর করে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ)। সফর শেষে ২১ জুলাই বাংলাদেশ নিয়ে ‘তথ্যপত্র’ প্রকাশ করে ইউএসসিআইআরএফ। সেখানে এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর প্রভাবের সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচন হয় ধর্মীয় উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে অথবা কমিয়ে দেবে। চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক সহিংসতা ঘটবে বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে। এখন পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েনের বাইরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি কর্তৃপক্ষ।
কয়েক দশক ধরে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদল হয়ে আসছে। ভোটকে আকৃষ্ট করতে উভয় দলই ধর্মকে ব্যবহারের ইতিহাস রয়েছে। আওয়ামী লীগকে যদিও ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। দলটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দলে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যদিও শেখ হাসিনার শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত ছিল। ২০২৫ সালের মে মাসে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের অধীনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে দলটি আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, আওয়ামী লীগ এবং এর নেতাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো শেষ হলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। বাংলাদেশে বিএনপিকে আরও রক্ষণশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্ণনা করা হয়। যার জামায়াতে ইসলামীর মতো ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীকে শেখ হাসিনার শাসনামলে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। গত জুনে জামায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সরকার।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ফলে বাংলাদেশে একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতিষ্ঠা হয়। আগস্টে সেনাবাহিনীর সহায়তায় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হন। তার পর থেকে সরকার বিভিন্ন ধরনের সংশোধন, সংস্কার এবং সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছে। কিন্তু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শঙ্কা দূর হয়নি।
দেশে চলমান সংবিধানের সংস্কার প্রক্রিয়া ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর প্রভাব ফেলেছে। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আলোচনায় ধর্মী সংখ্যালঘুরা অনুপস্থিত। গত অক্টোবরে প্রধান উপদেষ্টা দেশের সংবিধান সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। পরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন নতুন সংবিধানের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ পেশ করেছে। ফেব্রুয়ারিতে সরকার সাংবিধানিক সংস্কারসহ ছয়টি ভিন্ন কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনা এবং বিবেচনা করার জন্য ঐকমত্য কমিশনও প্রতিষ্ঠা করে।
সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার সম্ভাব্য অপসারণ
সংবিধানের সংস্কার প্রস্তাবনায় কমিশন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে ‘বহুত্ববাদ’ ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। এই সুপারিশটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপি ‘বহুত্ববাদ’ ব্যবহারের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটি ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাস’ শব্দটি আবারও যোগ করতে জোর দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) উভয়ই ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটি ব্যবহারে আংশিকভাবে একমত। তারা যুক্তি দিয়েছিল, এটিকে ‘বহু সংস্কৃতিবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত।
সাংবিধানিক সুরক্ষা সম্প্রসারণ
মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতার বিষয়ে সংস্কার কমিশন বৈষম্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার তালিকা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। যেখানে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম থেকে সুরক্ষা’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ রয়েছে। নাগরিকের জীবনের সুরক্ষা ও জামিনের অধিকার এবং আইনের বাইরে গিয়ে আটক সম্পর্কিত ধারাগুলো বাতিলের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। এটি শেখ হাসিনা সরকারের থেকে এ সরকারকে উল্লেখযোগ্যভাবে আলাদা করে। শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নাস্তিক ব্লগারদের লক্ষ্যবস্তু করা ও হত্যার পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সাংবাদিকসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের কারাদণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কতটা জড়িত তা এখনও স্পষ্ট নয়। সংস্কার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত না করা, পরামর্শ না করা, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্ব কম থাকায় অনেক ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হতাশা প্রকাশ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো মন্ত্রিসভার মধ্যে শুধু একজন সদস্য হিন্দু এবং একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সদস্য।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আক্রমণ, হয়রানি
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ওপর বিক্ষিপ্ত সহিংসতা এবং হয়রানি এখনও একটি সমস্যা। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর ২ হাজার ৯২৪টি হামলার নিন্দা করেছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় এ ঘটনাগুলোর জবাবদিহির অভাব থেকে যায়। এ ছাড়া হিন্দু, আদিবাসী এবং আহমদিয়া এবং সুফি মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
হিন্দুদের ওপর আক্রমণ
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বিক্ষোভের পর থেকে হিন্দু সম্প্রদায় সহিংসতা লক্ষ্যবস্তু। গত নভেম্বরে আনুমানিক ৩০ হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিক চট্টগ্রামে বিক্ষোভ করে। তারা সরকারের কাছে আক্রমণ এবং হয়রানি থেকে সুরক্ষার দাবি জানায়। বিক্ষোভকারীরা সরকারকে ১৯ জন হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্যও অনুরোধ করে, যাদের বিরুদ্ধে গত অক্টোবরে আগের বিক্ষোভে বাংলাদেশের পতাকার অসম্মান করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে হিন্দু পুরোহিত চিন্ময় দাস নভেম্বরে গ্রেপ্তার হন। গত জানুয়ারিতে জামিন নাকচ করলে নতুন করে বিক্ষোভ এবং সংঘর্ষ শুরু হয়, যাতে একজন মুসলিম আইনজীবীর মৃত্যু হয়। মুসলিম আইনজীবীর হত্যার পর হিন্দু এলাকাগুলোতে আক্রমণ ও ভয় দেখানোর ঘটনা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের মতো নাগরিক সমাজ দাবি করেছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
মার্চে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫-এর প্রথম তিন মাসে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে ৯২টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১১টি খুন, তিনটি ধর্ষণ, মন্দিরে ২৫টি আক্রমণ এবং ভাঙচুরের ২৮টি ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ৪৮টি আক্রমণের কথা জানিয়েছে। যার মধ্যে ২৫টি প্রতিমার ওপর আক্রমণও রয়েছে। হিন্দু ধর্মীয় নেতারা ইউএসসিআইআরএফকে ভয়ের অনুভূতির কথাও জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, কিছু এলাকায় হিন্দু নারীরা হয়রানি এড়াতে চুড়ি এবং সিঁদুর পরা বন্ধ করে দিয়েছেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় আইন প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ
২০২৪ সালের আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হয়রানি ও আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পুলিশের বেগ পেতে হচ্ছে। জুলাইয়ের বিক্ষোভের পরপরই পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়ে ও প্রায় সবাই প্রতিহিংসার ভয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। বিক্ষোভের সময় কয়েক ডজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। পুলিশের শূন্যস্থান পূরণ করে সেনাবাহিনী।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা জানিয়েছেন, সেনাবাহিনী সাম্প্রতিক সময়ের হয়রানি বা আক্রমণের ঘটনায় এগিয়ে আসছে। সেনাপ্রধান হিন্দুদের বৃহত্তম উৎসব দুর্গাপূজার সময় নিরাপত্তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তবে গত অক্টোবরের ছুটির আগের সপ্তাহগুলো ভয়ের ছিল বলে জানা গেছে। সে সময়ে হিন্দুদের মন্দির ভাঙচুরের কিছু ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থার মতে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ২০২৪ সালে দুর্গাপূজার সময় হিন্দুদের প্রতিমার ওপর ২৬টি হামলার ঘটনা ঘটে। দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামে একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ছয় সদস্য ইসলামী গান গেয়েছিল, পরে পুলিশ তাদের মধ্যে দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।