
অনলাইন ডেস্কঃ
বিশ্ব এখন নতুন এক পারমাণবিক উত্তেজনার দিকে ধাবিত হচ্ছে, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি রাশিয়ার জলসীমার কাছাকাছি দুটি কৌশলগত পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে অনেকে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের সূচনাস্বরূপ দেখছেন।
বিশ্বরাজনীতিতে এর প্রভাব স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক বাজারে এখনই উদ্বেগ ছড়িয়েছে, পশ্চিমা জোট ন্যাটোর মিত্রদেশগুলো সতর্ক অবস্থান নিয়েছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্ক নতুন করে উত্তেজনার শিখরে উঠেছে।
মেদভেদেভের হুঁশিয়ারি এবং ট্রাম্পের জবাব
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ ট্রাম্পকে সরাসরি সতর্ক করে বলেন, ‘ডেড হ্যান্ড’ নামক রুশ পারমাণবিক প্রতিশোধব্যবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বুঝে চলা উচিত। এই মন্তব্যের পর ট্রাম্প ওই সাবমেরিন মোতায়েনের নির্দেশ দেন এবং মেদভেদেভের বক্তব্যকে ‘উসকানিমূলক ও নির্বোধের মতো হুমকি’ বলে আখ্যা দেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মেদভেদেভ-ট্রাম্প এই বাক্যদ্বন্দ্ব পারমাণবিক যুগের সেই স্নায়ুযুদ্ধের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, যখন পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে হুমকি-প্রতিহুমকি বিশ্বকে একাধিকবার বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল।
ট্রাম্পের বার্তা স্পষ্ট: উসকানি বরদাশত নয়
ট্রাম্প দাবি করেছেন, সাবমেরিন মোতায়েন একটি প্রতিরক্ষামূলক ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। তবে সমালোচকরা বলছেন, এটি স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক প্রদর্শন। এর মাধ্যমে মস্কোকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে—ওয়াশিংটন এখন আর মুখ বুজে সহ্য করবে না।
সাবমেরিন মোতায়েনের পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর শুল্ক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জোরদার করা হচ্ছে। বিশেষত যেসব দেশ রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যেমন ভারত—তাদের ওপরও চাপ বাড়ানো হচ্ছে। ভারত, ব্রাজিল ও চীনের মতো ব্রিকস সদস্যদের রাশিয়ার প্রতি নরম মনোভাব ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন কতটা বিপজ্জনক?
ট্রাম্প যেসব সাবমেরিন পাঠিয়েছেন, সেগুলো ওহাইও-ক্লাস ব্যালিস্টিক সাবমেরিন। প্রতিটিই বহন করতে পারে একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেড এবং এগুলো রাডার ও শনাক্তকরণ ব্যবস্থার বাইরে থেকে কাজ করতে সক্ষম। এসব সাবমেরিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রায়াড’-এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও বিধ্বংসী অংশ।
‘ডেড হ্যান্ড’ এবং পারমাণবিক ভয়
মেদভেদেভ যেসব কথা বলেছেন, তা শুধুই কথার খেলা নয়। তার উল্লেখিত ‘ডেড হ্যান্ড’ ব্যবস্থা এমন এক পারমাণবিক কৌশল, যেখানে রাশিয়ার পুরো নেতৃত্ব ধ্বংস হয়ে গেলেও, একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা পারমাণবিক প্রতিশোধ চালাতে সক্ষম। এই তথ্য পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রবল উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে এবং ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
ভারত কি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক পদক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু?
ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র আমদানি অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প তার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। ব্রিকস জোটের দেশগুলোর প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি এখন কঠোরতর। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর চাপ বাড়িয়ে অন্যদের জন্য বার্তা দিতে চায়—ওয়াশিংটনের হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করা যাবে না।
পরমাণু উত্তেজনা বনাম কূটনৈতিক সমাধান
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বর্তমান উত্তেজনা কেবল সামরিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও বড় প্রশ্ন তুলছে। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিগুলো একের পর এক ভেঙে পড়ার পর এখন দুই দেশের মধ্যে কোনো কার্যকর কূটনৈতিক সংলাপ নেই।
আটলান্টিক ইনস্টিটিউটের পারমাণবিক কৌশল বিশেষজ্ঞ এলেনা পেত্রোভ বলেন, এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর সময়। পারমাণবিক সাবমেরিনের মতো বিষয় নিয়ে এমন উত্তেজনা ভুল ব্যাখ্যার ঝুঁকি বহন করে, যা একটি ভয়াবহ সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, শুধু অনলাইনে দেওয়া এক মন্তব্য কিংবা উত্তপ্ত বক্তব্য মুহূর্তেই বাস্তব জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে—বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি থাকলে।
সামনের দিনগুলোতে বিশ্ব কী দেখতে পারে?
ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন মোড় তৈরি করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—এই ঘটনা কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করবে, নাকি পারমাণবিক উত্তেজনার নতুন এক যুগের সূচনা করবে?
বিশ্বজুড়ে নেতাদের প্রতি আহ্বান উঠেছে- সতর্কতা ও সংযম প্রদর্শন করতে হবে। কারণ, পারমাণবিক যুগে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ওয়াশিংটন ও মস্কোর দিকে। এই উত্তেজনার পরিণতি কি হবে- কূটনীতি নাকি সংঘর্ষ তা নির্ধারণ করবে সামনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।