
অনলাইন ডেস্কঃ
প্রথম যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম তখন ভেবেছিলাম এক মাসের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরবো। কিন্তু সেই এক মাসের আশা আজ এক বছরের দীর্ঘ যন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে। বাড়ি ফেরা তো হয়নি, বরং হাসপাতালের বেড আর করিডোরই হয়ে উঠেছে ঠিকানা। কথাগুলো বলছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত জাবেদ ইকবাল। গত বছরের ৪ঠা আগস্ট রাজধানীর কাওরান বাজারে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তখন থেকেই তার ঠিকানা হাসপাতালের বেড। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেছে, কিন্তু সময় যেন থমকে আছে হাসপাতালের প্রতিটি করিডোরে, যেখানে এখনো চিকিৎসাধীন অবস্থায় পড়ে আছেন জাবেদের মতো অনেক আহত। কেউ হাঁটতে পারেন না, কেউ কথা বলতে পারেন না, কারও শরীরের অর্ধেকটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে, আবার কেউ চোখে দেখতে পারেন না। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪০ জন জুলাইযোদ্ধা।
গত ৩১শে জুলাই ব্যাংকক থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন মোহাম্মদ সোহেল। উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছিল তাকে, ফেরার পরপরই ভর্তি হন বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণে ছিলেন কয়েকদিন। শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ায় গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়। তবে চিকিৎসা শেষ হলেও জীবনের লড়াই থেমে থাকেনি তার জন্য। বাম পা হারিয়ে ফেলেছেন, যা তার ভবিষ্যৎকে এক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সোহেল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত ছিলেন। জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন ছিল সেই চাকরি। এখন পা হারানোয় সেই কাজ করা আর সম্ভব নয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের নির্বিচারে গুলি করার দৃশ্য দেখে ঘরে বসে থাকতে পারেননি সোহেল। ১৮ তারিখ থেকে নিয়মিত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। গত বছরের ২০শে জুলাই শনির আখড়ায় পুলিশের গুলি তার পেট ভেদ করে চলে যায়। আরেকটি গুলি বিদ্ধ হয় পায়ে। তিনি বলেন, যখন গুলিবিদ্ধ হই তখন আমাকে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়নি। সব জায়গায় পুলিশ-আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী বাহিনী চেক করতো আহত কেউ হাসপাতালে এসেছে কিনা। গোপনীয়ভাবে মুগদা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিয়েছি। সরকার পতনের পর মনে একটা আশা জন্মেছে যে, আর লুকোচুরি করে চিকিৎসা নিতে হবে না। এরপর যখন আমার অবস্থা খারাপ হয় তখন সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৩শে নভেম্বর ব্যাংককে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার খাদ্যনালীর অপারেশন সমপন্ন হয়।
বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা জাবেদ ইকবাল। গত বছরের ৪ঠা আগস্ট কাওরান বাজারে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এক বছর ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। বলেন, পায়ে ইনফেকশন থাকায় গত ১৫ই জুলাই পায়ের মাংস কেটে ফেলা হয়েছে। প্রতিদিন ড্রেসিং করাতে হয়। গত বছরের ১০ই আগস্ট আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার ঠিক ছয়দিন আগে আমি গুলিবিদ্ধ হই। তখন থেকেই সিআরপি, সিএমএইচ হাসপাতালের বেড আমার ঠিকানা হয়ে আছে। পা ভালো না হওয়ায় গত ৬ই মার্চ বাংলাদেশ মেডিকেলে আসি।
‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ মিডিয়া অ্যান্ড পিআরও কর্মকর্তা মো. জাহিদ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মোট ভেরিফাইড আহত সংখ্যা ১৪৫৪১ জন এবং শহীদের সংখ্যা ৮৫২ জন। জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছর পরেও পিজি হাসপাতালে ৪০ জন, নিটোরে ১০ জন এবং সিএমএইচে ভর্তি আছে ১২ জন। এদের সবাই গুরুতর আহত। এ ছাড়া আন্দোলনে আহত অনেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে থাকা ৭ জন ডাক্তারের টিম আহতদের সার্বিক সহযোগিতায় নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়া আহত ও শহীদ পরিবারগুলোকে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আর্থিক, আইনি, চিকিৎসা এবং পুনর্বাসন সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের জিএস সামসি-আরা-জামান বলেন, আমরা আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে শহীদ পরিবার ও আহতদের ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ পক্ষ থেকে একটি করে গিফট দিচ্ছি। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় আমরা দিচ্ছি। ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ সংশ্লিষ্ট সবাই দিন-রাত পরিশ্রম করছি জুলাইযোদ্ধাদের সহায়তার জন্য।