
অনলাইন ডেস্কঃ
আগামীকাল ২১ আগস্ট চারদিনের সফরে ঢাকায় আসবেন পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান। এর দুইদিন পর ২৩ আগস্ট দুইদিনের সফরে আসবেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। আর সেপ্টেম্বর অথবা অক্টোবরে বাংলাদেশে আসতে পারেন দেশটির অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে ঢাকায় পাকিস্তানের তিনমন্ত্রীর সফর ঘিরে শুরু হয়েছে নানা বিশ্লেষণ। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন প্রেক্ষাপট ও দক্ষিণ-এশিয়ার নতুন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতে পাকিস্তানের তিনমন্ত্রীর সফর ‘নতুন সম্পর্কের’ ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন কূটনীতি বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে, দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান আগামীকাল ২১ থেকে ২৪ আগস্ট ঢাকা সফর করবেন। তার সফরে বাণিজ্য, হালাল ফুড প্রসেসিং, কানেকটিভিটি, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের পাশাপাশি কৃষি, প্রতিরক্ষা, খাদ্য, যোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া, আলোচনায় সার্কসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলোর দাবি, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের দুইদিনের সফর শুরু হবে ২৩ আগস্ট। তার এই সফর অবশ্য আগেই ঠিক হয়ে ছিল। গত এপ্রিলে তার বাংলাদেশ সফরের কথা ছিল। কিন্তু ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে তিনি সফরটি স্থগিত করেন। আর আগামী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে দুই দেশের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) বৈঠকে অংশ নিতে দেশটির অর্থমন্ত্রী মুহাম্মদ আওরঙ্গজেবের ঢাকায় আসার কথা। এই বৈঠকে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। উল্লেখ্য, দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ জেইসি বৈঠক ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিগত হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একেবারে তলানিতে পৌঁছায়। ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর পরই নতুন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে মনযোগ দেয়। নতুন নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশ সবদেশের সঙ্গেই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতি। গতবছরের ৫ আগস্টের পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে রীতিমতো অস্থিরতা চলছে। এর বিপরীতে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক নতুন গতি পেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইসহাক দারের আসন্ন ঢাকা সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসন্ন সফরের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যোগ হবে নতুন মাত্রা। বহু বছর পর আবার দু’দেশের মধ্যে শুরু হতে যাচ্ছে আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংলাপ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দু’দেশের সম্পর্ককে ‘নতুন যাত্রা’ হিসেবে দেখছে পাকিস্তান।
এদিকে, এরই মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আরোপ করা ভিসা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে। করাচি থেকে পণ্য নিয়ে কার্গো শিপ চট্টগ্রাম এসেছে। ফ্লাই জিন্নাহ এবং এয়ার সিয়াল নামে বেসরকারি দু’টি বিমান সংস্থাকে সরাসরি বাংলাদেশে ফ্লাইট অপারেশনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রে ফের নতুন করে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল পাকিস্তান সফর করেছে। এছাড়া, গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নৌমহড়া ‘আমান-২০২৫’-এ অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। সব মিলিয়ে দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক যোগাযোগ শুরু হয়েছে।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘১৫ বছর পর গত এপ্রিলে দু’দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের মাধ্যমে নতুন করে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক নিয়েও কথা হচ্ছে।’
আর ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, আমরা সম্পর্কের এক নতুন যাত্রা শুরু করেছি। এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে যেকোনো ইস্যুতে আলোচনায় প্রস্তুত রয়েছি। এমনকি ১৯৭১ নিয়েও আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশও বলছে, অতীতের দাবিগুলোতে বৈঠকে উত্থাপনের মাধ্যমেই এগিয়ে নিতে হবে নতুন সম্পর্ক। কোনো নিদির্ষ্ট ইস্যুতে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে আটকে রাখা হবে না।
ইসহাক দারের আসন্ন সফরের গুরুত্ব এবং বৈঠকের এজেন্ডা সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি একটি রাজনৈতিক সফর। এ সফরের গুরুত্ব অনেক। ইসহাক দার পাকিস্তান সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের পরই তার স্থান। সুতরাং, দু‘দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে তার এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের নতুন সূচনা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এরই মধ্যে আমাদের প্রধান উপদেষ্টার দু’বার দেখা হয়েছে। দুই নেতাই সম্পর্ক জোরদারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুই দেশের নানা পর্যায়ের আলোচনা সক্রিয় করতে উদ্যোগী হয় পাকিস্তান। দুই দেশের দেড় দশকের শীতল সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে গত এপ্রিলে ঢাকায় এসেছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব আমনা বালুচ। এরই ধারাবাহিকতায় ইসহাক দার আসছেন। তিনি তার সফরে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক স্তরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের পর সম্পর্ক পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বার্তা থাকবে ইসহাক দারের সফরে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে ২৪ আগস্ট। বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে এবং সরকারি নথি পর্যালোচনা করে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় সফর বা বৈঠকের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন বৈঠকে সম্পর্ক ও সহযোগিতার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। বৈঠকের আলোচ্যসূচি নিয়ে এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তৌহিদ হোসেন-ইসহাক দার আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর একাধিক সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। সইয়ের তালিকায় থাকা সমঝোতাগুলো হলো- দুই দেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়।
এর আগে গত মাসে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন রাজা নাকভি ঢাকায় এসেছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই সফরের পর দুই দেশের কূটনৈতিক ও সরকারি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসাবিলোপ চুক্তি সইয়ের বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। দুই দেশ চুক্তির খসড়া বিনিময় করেছে। আগামী সপ্তাহে রাজনৈতিক স্তরে অনুমোদন পেলে ইসহাক দারের সফরেরই এই চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খানের সফরে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে চাঙা করা যায়, সে বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে জাম কামাল খানের ঢাকা সফরের সময় এই সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। বাণিজ্যবিষয়ক এই ওয়ার্কিং গ্রুপের নেতৃত্ব দেবেন দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবরা।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু করছি না। অন্য অনেক দেশের মতোই আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। যেখানে ব্যবসা, বিনিয়োগের পাশাপাশি মানুষের চলাচল সুগম করার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈরী সম্পর্কের প্রয়োজন নেই। অতীতে অকারণে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরি সম্পর্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এসেছি। পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক করার সময় অমীমাংসিত তিন বিষয় আলোচনার টেবিলে থাকছে।’
তার মতে, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দু’দেশের মধ্যে একটি ইতিবাচক সম্পর্কের জন্য আমরা কাজ করছি। ইসহাক দারের সঙ্গে আমরা দ্বিপক্ষীয় সব ইস্যুতেই কথা বলব। ৭১-এর বিষয়টিও আলোচনায় আসতে পারে। তবে একটি ইস্যুর জন্য অন্যসব ইস্যু আটকে থাকবে না।’ ঢাকা-ইসলামাবাদ ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের উদ্বেগের ব্যাপারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক কেমন হবে, তা ভারত নির্ধারণ করবে না। কারণ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বিষয়টি আমরা নির্ধারণ করে দিই না।’
পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার রুহুল আলম সিদ্দিক বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থবির করে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ভিসা বন্ধ করা ছিল একটি অমানবিক পদক্ষেপ। পাকিস্তানে প্রায় ২৫ লাখ বাঙালি রয়েছে। বছরের পর বছর তারা তাদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি।’ তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ধরে রাখতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতেই হবে।’