
অনলাইন ডেস্কঃ
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন সামাল দিতে না পারলে মার্শাল ল’ জারি করানোর যে পরিকল্পনা শেখ হাসিনা নিয়ে রেখেছিলেন তা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বক্তব্যেও প্রমাণিত।
শেখ হাসিনা পালানোর পর ৫ আগস্ট ২০২৪ বিকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের বৈঠক হয়। বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানকে মার্শাল ল’ জারির প্রস্তাব করেছিলেন।
অর্থাৎ শেখ হাসিনার এই পূর্বপরিকল্পনার বিষয়টি তিনিও জানতেন এবং তাদের সহযোগী হিসেবেই তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বৈঠকে মার্শাল ল’ জারি করানোর শেষ চেষ্টা করেন।
২০২৪ সালের ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করবে না।’ সেনাসদরে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের প্রেক্ষিতে সেনাপ্রধান তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন সেনাবাহিনী মার্শাল ল’ জারি করবে না। এরপর শেখ হাসিনা নতুন পরিকল্পনা হিসেবে ৪ আগস্ট দেশব্যাপী জরুরি অবস্থা জারি করানোর প্রচেষ্টা চালান। বঙ্গভবন সূত্রে পাওয়া খবর ইতঃপূর্বে আমার দেশ-এ ছাপা হয়।
এতে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে ফোন করে শেখ হাসিনা জরুরি অবস্থা জারির বিষয়টি জানিয়ে তৈরি থাকতে বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী যে কোনো সময় বঙ্গভবনে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার জরুরি অবস্থা জারির চেষ্টাও সেদিন ব্যর্থ হয়েছিল।
পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে মার্শাল ল জারি করানোর পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনার। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা দেওয়ার কথাবার্তা চূড়ান্ত করে রেখেছিলেন। মার্শাল ল জারি করানোর এ বিষয়টি শেখ হাসিনার অতিঘনিষ্ঠ কয়েকজন জানতেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ রেহানা ও সালমান এফ রহমান।
গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে শেখ রেহানা ও সালমান এফ রহমানের মধ্যে টেলিফোনে যে কথোপকথন হয়, সেখানে মার্শাল ল জারি করার বিষয়টি প্রকাশ পায়। আমার দেশ-এর ধারাবাহিক অনুসন্ধানে রেহানা-সালমানের সর্বশেষ টেলিফোন সংলাপ থেকে বিষয়টি জানা যায়। সেই টেলিফোন সংলাপ আমাদের হাতে এসেছে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী সামরিক সচিব (এএমএসপিএম) কর্নেল রাজীব শেখ রেহানাকে সালমানের সঙ্গে ফোনে ধরিয়ে দেন। কথোপকথনের একপর্যায়ে শেখ রেহানার কাছে সালমান এফ রহমান জানতে চান, ‘ও কী বলে (সেনাপ্রধান)? মার্শাল ল ডিক্লেয়ার করছে না কেন? অর্থাৎ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রয়োজনবোধে মার্শাল ল জারি নিয়ে কথাবার্তা হয়েছিল। কথোপকথনে শেখ রেহানা সালমানকে এ কথাও জানান যে, তার ছেলে ববি ও মেয়ে টিউলিপ ‘কনভিন্স’ করেছে; অর্থাৎ তিনি সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যেতে রাজি করানো সম্ভব হয়েছে। কথোপকথনে শেখ রেহানা সালমান এফ রহমানকে তার ছেলে সায়ান ও শেখ হাসিনার ছেলে জয় যে কথা বলেছে সেটা করার অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা সালমানকে দ্রুত সরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সালমান তার সঙ্গে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হককেও নিতে চাইলে শেখ রেহানা সায় দেন। অর্থাৎ হাসিনা-রেহানার সঙ্গে একই বিমানে ভারতে পালানোর কথা ছিল সালমানের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিমান বাহিনীর ওই বিমানে সালমান ও আনিসুল হক পালাতে পারেননি। বুড়িগঙ্গা দিয়ে পালাতে গিয়ে তারা গ্রেপ্তার হন।
শেখ রেহানা ও সালমানের টেলিফোন সংলাপ
কর্নেল রাজীব : স্লামালিকুম স্যার।
সালমান রহমান : হ্যালো।
কর্নেল রাজীব বলছি স্যার। রেহানা আপা একটু কথা বলবেন, ওভার টু ওভার স্যার।
সালমান রহমান : কে?
কর্নেল রাজীব : রেহানা আপা।
শেখ রেহানা : স্লামালিকুম ভাইয়া।
সালমান রহমান : হ্যাঁ, ওয়ালাইকুমুস সালাম।
শেখ রেহানা : আপনি কই?
সালমান রহমান : আমি আমার বাসায়।
শেখ রেহানা : থাইকেন না।
সালমান রহমান : থাকব না; ঠিক আছে।
শেখ রেহানা : আমরা অন্য জায়গায় আছি, অ্যাঁ… ববি, টিউলিপ (শেখ রেহানার ছেলে ও মেয়ে) কনভিন্স করেছে। ফোন না করতে পারলেও আল্লাহ যদি বাঁচাই রাখে, কথা হবে। (সম্ভবত হেলিকপ্টার থেকে ফোনটি করেন।)
সালমান রহমান : আচ্ছা, তোমরা অন্য জায়গায় চলে গেছ? আপাও (শেখ হাসিনা) গেছে?
শেখ রেহানা : জি ভাই। তো আপনি…
সালমান রহমান : আমরা যদি বাহির হইতে পারি, বাহির হইয়া যাব। আনিসুলকেও (আইনমন্ত্রী) বের করে ফেলি সাথে।
শেখ রেহানা : হ্যাঁ, হ্যাঁ। ইমিডিয়েটলি আপনি সায়ান (সালমান রহমানের ছেলে) এবং জয় (শেখ হাসিনার ছেলে) যেটা বলেছে, সেটা করেন।
সালমান রহমান : ঠিক আছে।
শেখ রেহানা : এক সেকেন্ডও দেরি কইরেন না। কারণ শম্পার (শেখ হেলালের ভাই শেখ জুয়েলের স্ত্রী, গুলশানে বাসা) বাসায় গেছে। কথা চলছে। চারদিকে সাদা জুব্বাওয়ালা ও দাড়িওয়ালা এই আর কি! ইউ শুড লিভ, এখানে থাকা একদম সেইফ না।
সালমান রহমান : আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে। ও কী বলে? মার্শাল ল’ ডিক্লেয়ার করতেছে না ক্যান?
শেখ রেহানা : ওগুলোতে এখন আর কান দিয়েন না। ইউ শুড লিভ ইমিডিয়েটলি। এক সেকেন্ডও দেরি কইরেন না।
সালমান রহমান : ওকে।
শেখ রেহানা : জি ভাইয়া, ফি আমানিল্লাহ। দোয়া কইরেন।
সালমান রহমান : ফি আমানিল্লাহ। ফি আমানিল্লাহ।
শেখ রেহানা : স্লামালিকুম।
সালমান রহমান : স্লামালিকুম।