
অনলাইন ডেস্কঃ
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা সফর করবে। ইইউর প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলে তিন বিদেশি এবং চার স্থানীয় মিলিয়ে সাতজন থাকবেন এবং দলটি আগামী ৭ অক্টোবর বাংলাদেশে তাদের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ শেষ করবে বলে কালবেলাকে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
বাংলাদেশ সফরকালে দলটি আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ পরিবেশ রয়েছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করবে। এই অনুসন্ধানী সফরের ভিত্তিতে ইইউ সিদ্ধান্ত নেবে, তারা বাংলাদেশে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কি না। সফরকালে দলটি নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ এবং সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে মতবিনিময় করবে বলে নিশ্চিত করেছে আরেকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।
প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্রাসেলসের একটি সূত্র বলে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম সাধারণত নিজস্ব মূল্যায়ন ও স্বাগতিক দেশের অনুমতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এবারও উভয় পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে তারা পর্যবেক্ষণে যাচ্ছেন।
কীভাবে কাজ করবে ইইউ প্রাক পর্যবেক্ষণ দল :
ইইউ সাধারণত দুই ধাপে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রথম ধাপে একটি প্রাক-নির্বাচনী অনুসন্ধানী দল পাঠায়। এবার ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা আসছেন তারা মূলত নির্বাচনের পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, এবং সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করবে। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইইউ সিদ্ধান্ত নেবে, তারা ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে কি না।
এই প্রক্রিয়ায় তারা নির্বাচন কমিশন, অন্তরবর্তী সরকার, বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবে। দলটি সাধারণত নির্বাচনের স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ, সহিংসতা ও ভয়ের পরিবেশ আছে কি না, এসব বিষয় খতিয়ে দেখবে।
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে ইইউর অবস্থান :
বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসন নিয়ে ইইউ বরাবরই সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে আগ্রহী। তারা মনে করে, একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ।
ইইউ বাংলাদেশে এর আগেও বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে, বিশেষ করে ২০০৮ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে। তবে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি, বরং একটি ছোট অনুসন্ধানী দল পাঠিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করেছিল। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম বেশ আলোচিত ছিল। তারা শুরুতে আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি।
ইইউ সাধারণত নির্বাচনের অন্তত ছয় মাস আগে প্রাক-নির্বাচনী দল পাঠায়, যাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতির জন্য। প্রথমত, প্রাক-নির্বাচনী দল রাজনৈতিক পরিবেশ, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, লজিস্টিক সুবিধা এবং বাজেট কাঠামো মূল্যায়ন করে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তৈরি করে। এই প্রতিবেদন ইইউ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়, যেখানে তা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়- পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল পাঠানো হবে কি না।
দ্বিতীয়ত, যদি পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে পর্যবেক্ষকদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, ভিসা প্রক্রিয়া, যাতায়াত এবং মাঠ পর্যায়ে কাজের প্রস্তুতির জন্য কয়েক মাস সময় প্রয়োজন হয়। এই প্রস্তুতি যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হলে পর্যবেক্ষক দলকে আগেভাগেই সফর করতে হয়। ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী দল বাংলাদেশে সফর করেছিল জুলাই ২০২৩-এ, অর্থাৎ নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস আগে। যদিও বর্তমানে দেশের নির্বাচনের নিদিষ্ট কোনো তারিখ নির্ধারণ হয়নি তবে গত ১৩জুন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস তার লন্ডন সফরকালে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় আগামী বছরের রমজানের আগে হওয়ার বিষয়ে নীতিগত সম্মতি দেন। তবে এখনো নির্বাচন কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি।
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধকে অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের বাধা মনে করতে পারে ইইউ :
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এক ঘোষণায় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দলটির অনলাইন উপস্থিতি, রাজনৈতিক সভা, এমনকি নির্বাচনী প্রস্তুতিও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে, ফলে দলটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আসন্ন নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না তা নিয়ে ইইউ কনসার্ন দেখাতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) যে প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে, তার উদ্দেশ্য হবে নির্বাচনী পরিবেশ, অংশগ্রহণমূলকতা এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা মূল্যায়ন করা। তবে আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়া এই পর্যবেক্ষকদের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে বলছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ইইউ সাধারণত এমন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে যেখানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশগ্রহণ করে এবং গণতান্ত্রিক পরিসর বজায় থাকে। আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ভোটাররা অংশগ্রহণ না করতে পারলে দেশের প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি না তা তারা মূল্যায়ন করবেন। এমন পরিস্থিতিতে ইইউ পর্যবেক্ষক দল যদি মনে করে যে, নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, তাহলে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ মিশন পাঠানো থেকে বিরত থাকতে পারে। তারা নির্বাচনকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ ঘোষণা করতে পারে, যদি প্রধান দলগুলো অংশগ্রহণ না করে। নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য ইতোমধ্যে মন্তব্য করেছেন যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন আয়োজনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
সূত্রঃ কালবেলা