
বিশেষ প্রতিনিধি:
এমএইচ সেলিম, আলি আসগর লবি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু। খুলনা- বাগেরহাটে পরিচিত মুখ। রিনাউন ফিগার। তিনজনাই সাবেক এমপি। দলে তারা একসময়ে প্রচন্ড প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। প্রথম দুজনা রীতিমতো ধনকুবের। তৃতীয় জন ধনকুবের না হলেও তার আর্থিক অবস্থা একেবারে খারাপ না।
সূত্র বলছে, সেলিম যিনি সিলভার সেলিম নামেই বেশি পরিচিত, তিনি ও আলি আসগর লবি পৃথক পৃথকভাবে ব্যাবসা- অঙ্গন থেকে দলে এসেছেন। পরে নেতা হয়েছেন। আরও পরে এমপি হয়েছেন। জানা গেছে, এই তিনজনাই বর্তমানে দলছুট। দলে ফেরার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তিনজনার মধ্যে দুজন ইতমধ্যে লন্ডন থেকে ঘুরে এসেছেন। তারেক রহমানের সাথে দেখাও করেছেন। দলে সক্রিয় হওয়া বা আগামীতে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন, এমন সিগন্যাল এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মেলে নি। ফলে, তাদের নিজ নিজ বলয়ের নেতা-কর্মী, সমর্থক, শুভাকাঙ্ক্ষীরা চরম্ভাবে হতাশ। এদের মধ্যে দুজন এবার নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকাতেই যাননি। অন্যজন, ঈদের দিন নামাজ শেষে গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ বা সিটি করপোরেশনে মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী হবেন।
সূত্র বলছে, দেশের বিশিষ্ট ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ী সিলভার সেলিম ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে দলে নিস্ক্রিয়। সেই সময়ে গ্রেফতারও হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পরে ব্যাপক মারধরের শিকারও হন তিনি। জেল থেকে বের হয়ে আর দলমুখি হন নি। দলের জেলা সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। গত দুই দশক ধরে দলের পরিচয় তার কাছে কেউ গেলে তিনি তাকেই ধমক দিতেন। বিএনপিকে গালিগালাজ দিতেন। জোর গলায় বলেছেন, আমি বিএনপি করি না।
দলের লোকজন তার কাছে আসলে তিনি বলতেন, সালাম বিএনপি করে, তোমরা ওর কাছে যাও। বেগম জিয়া- তারেক রহমানকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। জীবনে কোন দিন বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারবে না এমন কথা গর্বের সাথে বলেছেন এক সময়ের জেলা সভাপতি, বাগেরহাট সদর আসনের সাবেক এমপি সিলভার সেলিম। সেই সেলিম এখন দলে ফিরতে মরিয়া। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী। দলে ফিরে এমপি প্রার্থী হতে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন।
অন্যদিকে, বাগেরহাটের নিজ বাসভবনে জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি, সাবেক এমপি সিলভার সেলিমের আপন ছোট ভাই, মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বলেছেন, নিজের ভাই, কিছুই বলার নেই। সালাম জানান, তার ভাই রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কিছুই দেখেন না। এক পা আগান না।
সালাম আরও বলেছেন, সে আমার ভাই নামের কলঙ্ক। দলের দু:সময়ে তিনি আমাদের সবাইকে ছেড়ে আলাদা ছিলেন। আওয়ামী লীগের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন। ব্যবসা বাগিয়েছেন। নিজের বিরুদ্ধে আনিত মামলাসমুহ আওয়ামী লীগের সাথে মিলে মিশে নিষ্পত্তি করেছেন। অভিযোগের সুরে সালাম বলেছেন, ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি নতুন করে তৎপরতা শুরু করতে চেয়েছিলেন। বাগেরহাট বিএনপির লোকজন তাকে অলরেডি লাল কার্ড দেখিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, সিলভার সেলিম, লন্ডন ও ঢাকাতে অবস্থানরত আরও দুই একজন নেতা বাগেরহাট বিএনপিকে কলুষিত করতে চাইছে। তারা ডার্টি গেম মঞ্চস্থ করতে চাইছে। দৃঢ়তার সাথে আব্দুস সালাম বলেছেন, তাদের এই স্বপ্ন কোনভাবেই পূরণ হবার নয়।
সাবেক এমপি এমএইচ সেলিমের যে কোন রাজনৈতিক অপতৎপরতার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে প্রস্তুত রয়েছে বাগেরহাট বিএনপি।
উল্লেখ্য রোজার আগে স্থানীয় বিএনপির বাধার মুখে সিলভার সেলিম জোর পূর্বক বাগেরহাটে ঢুকতে গেলে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি করে। তারপর থেকে তিনি আর বাগেরহাটমুখি হননি।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী অঙ্গন থেকে আসা আলি আসগর লবি খুলনা সদরে দুই দফায় এমপি ছিলেন। প্রথমে বেগম জিয়ার ছেড়ে দেয়া আসনে উপ নির্বাচনে লবি জয়ি হন। পরে ২০০১ এর নির্বাচনে লবি দ্বিতীয় দফায় এমপি হন। জনশ্রুতি আছে, তারেক রহমানের ব্যক্তিগত অফিস হাওয়া ভবনের মালিক ছিলেন লবি। পাশাপাশি লবি বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিবি) প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
২০১৬ বা ১৭ এর দিকে আলি আসগর লবি পদত্যাগের ঘোষনা দিয়ে বিএনপি ত্যাগ করেন। আলাপকালে লবি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের সাথে তার ব্যক্তিগত সখ্যতা ছিলো কিন্তু তিনি দল ছেড়ে যান নি।
দেশের শীর্ষ স্থানীয় এই ম্যানপাওয়ার ব্যবসায়ী আরও বলেছেন, বরাবরই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলে আসছে। তিনি আরও বলেছেন, তিনি দলে নিস্ক্রিয় ছিলেন বলে যেটা বলা হচ্ছে, বিষয়টা আদতেই তেমন নয়। তিনি যা করেছেন, সেটা দলের চেয়ারম্যান বেগম জিয়া, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নলেজে দিয়েই করেছেন।
লবি দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ আমলে তিনি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ হয়েছে। দুদকের মামলায় তিনি ফেসে গিয়েছেন। জেলে গিয়েছেন। গত রোজায় লবি খুলনা শহরে তার নির্বাচনি এলাকায় ইফতার ও শিত মৌসুমে কম্বল বিতরন করেন। কিন্তু দলের মহানগর বা ওয়ার্ড ইউনিট সংশ্লিষ্ট কেউ সংযুক্ত না থাকায় সমালোচনার ঝড় উঠে। লবির এসব কার্যক্রমে তার গাড়ির ড্রাইভার, খুলনা বিএনপি অফিসের এক পিওন, এবং লবির অফিসের এক সাবেক নারী কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইফতার বিতরণ নিয়ে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, খুলনার আরেক আলোচিত নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু ২০০৯ এর নির্বাচনে এমপি হন। সেই নির্বাচনে সারা দেশে দলের ভরাডুবি হলেও মঞ্জু ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার জেরে খুলনা সদর আসনে এমপি নির্বাচিত হন। মঞ্জু দীর্ঘদিন খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি ছিলেন। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
ওয়ান ইলেভেনের সময়ে মঞ্জু সংস্কারপন্থী ছিলেন, এমন দাবি দলের মূলধারার নেতা কাজি মাহমুদের। খুলনার নিজ বাসভবনে আলাপকালে খুলনা মহানগর বিএনপির এই নেতা জানান, অভিযোগ আছে, বেগম জিয়া ও তারেক রহমান সেই সময়ে কারাবন্দী হলে নজরুল ইসলাম মঞ্জু গনমাধ্যমকে প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, অবস্থা পর্যবেক্ষণে আছি, প্রতিক্রিয়া পরে জানাবো।
কাজি মাহমুদের দাবি, নজরুল ইসলাম মঞ্জু তখন দলের মূলধারা থেকে নিজেকে কৌশলে সরিয়ে নেন। তিনি আরও বলেন, আমরা দলের নেতা-কর্মীরা তখন পলাতক, অথচ মঞ্জু সাহেব তখন নির্বিঘ্নে ঢাকা- খুলনা শহরে ঘুরেছেন।
গ্রেফতারের দুদিন আগে তারেক রহমান নিজেই নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ফোন দিয়ে দেশে আন্দোলন গড়ে তুলতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু মিছিল সমাবেশে মঞ্জু সাড়া দেনি নি, এমন দাবি কাজি মাহমুদের।
উপরন্তু মঞ্জু গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, হাওয়া ভবন বা তারেক রহমানের দায়িত্ব আমরা বা বিএনপি কেন নিবো? অভিযোগ আছে, মঞ্জু নিজেই নিজেকে দলের মূলধারা থেকে সরিয়ে নেন ওবং প্রয়াত মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়ার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। পরে সংস্কারপন্থী গ্রুপে নাম লেখান, আলাপকালে যোগ করেন কাজি মাহমুদ।
সেই সময়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি দীর্ঘদিন খুলনা ছেড়ে ঢাকাতেও অবস্থান করেন। মূল ধারার নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মঞ্জু- মনি সেই সময় বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের পক্ষে কোন অবস্থান নেননি, এমনকি বেগম জিয়া বা তারেক রহমানের দু:সসময়ে দলের পক্ষে মিছিল- সমাবেশ বা বিবৃতি দেননি, এমন দাবি কাজি মাহমুদের।
তিনি বলেন, সারাদেশের মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীরা সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তারুণ্য, পরিশ্রমী, ত্যাগী নেতৃত্ব প্রত্যাশা করছে এবং দলও সেটা ভাবছে, এমন ধারণা কাজি মাহমুদের।
সূত্র বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে বিএনপির সংস্কার প্রক্রিয়া ধামাচাপা পড়ে যায়। বেগম জিয়ার ঘনিষ্ঠভাজন হিসাবে নজরুল ইসলাম মঞ্জু সেই যাত্রায় রেহাই পান। পরে বেগম জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়লে দল তারেক রহমান নির্ভর হয়ে পড়ে।
দলের ড্রাইভিং সিটে তারেক রহমান বসলে মঞ্জুর কপাল পুড়ে। মঞ্জু- মনির নেতৃত্বাধীন কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। অনেকটা নাটকীয়ভাবে জেলার রাজনীতি থেকে এডভোকেট শফিকুল আলম মনাকে সরিয়ে এনে দলের নগর শাখার আহবায়ক ও শফিকুল আলম তুহিনকে সদস্য সচিব করা হয়।
সূত্রমতে, মঞ্জু- মনির কমিটি ভেঙে দেয়া হলে নজরুল ইসলাম মঞ্জু রাজপথে কমিটি ভাঙার বিরুদ্ধে নিয়মিত মিছিল সমাবেশ করেন। মঞ্জুর সমর্থনে বেশ কিছু নেতা দল থেকে পদত্যাগ করে মঞ্জুর পক্ষে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে বেশ কিছু নেতিবাচক মন্তব্য করেন। সেই থেকেই মঞ্জু দলের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে আছেন। দল করার সুযোগ পেলেও মঞ্জুকে দলে উপেক্ষিত রাখা হয়েছে। বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল- দলের কেন্দ্রীয় তথ্য বিষয়ক সম্পাদক, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আজিজুল বারি হেলাল ও আরেক সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা জিয়াউর রহমান পাপুলের সহায়তায় খুলনাতে মনা- তুহিনকে নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়ে ছাড়েন।
এইভাবেই রাজনৈতিকভাবে পরাজয় ঘটে একসময়ের দাপুটে নেতা, ছাত্রদলের মাঠ পর্যায়ে থেকে উঠে আসা সোনালি অতীত, সাবেক ছাত্রদল নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুর। সূত্র বলছে, মঞ্জু- মনির কমিটি ভেঙে যাবার পরে প্রকাশ্যে, সংবাদ সম্মেলন করে নজরুল ইসলাম মঞ্জু একাধিকবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে ক্ষমা চেয়ে দু:খ প্রকাশ করলেও তারেক রহমানের মন জয় করতে পারেন নি। বা আজ অবধি মূলধারায় ফিরে যাবার গ্রিন সিগন্যাল পান নি।
তবে, দলের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে মঞ্জুর সাথে তার অনুসারীরা আজও তার সাথে আছে। মঞ্জুর দীর্ঘদিনের অনুসারি নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ তরিকুল ইসলাম বলেছেন, খুলনাতে দলের বিপুল সংখ্যক নেতা কর্মীকে বাইরে থেকে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না, দলের চেয়ারম্যান বেগম জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিশ্চয়ই বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবেন। এতে রেজাল্ট হিতে বিপরীত হতে পারে, যা কারোর জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
অন্যদিকে, লবি- মঞ্জুর বিতর্কিত ভুমিকা ও অবস্থানের বিপরীতে ছাত্রদল থেকে উঠে আসা দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম তুহিন নিজেকে এমপি পদে প্রার্থী হিসাবে গড়ে তোলেন। দুই দুইজন হেভিওয়েট প্রার্থীর পাশে তরুণ প্রার্থী হিসাবে তুহিন রীতিমতো আলোচনায়।
তুহিন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থানীয় খুলনা বিএনপির অভিভাবক বকুল- হেলাল- পাপুলের আস্থাভাজন। ইতিমধ্যেই দলের ভেতরে নিজের অপরিহার্যতা প্রমান করেছেন। সদ্য সমাপ্ত রমজান মাসে নিজ নির্বাচনী এলাকার ১৬;টি ওয়ার্ডেই ইফতার পার্টিতে ব্যাপক ভুমিকা রেখেছেন তুহিন। নিজেকে কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন।