
অনলাইন ডেস্কঃ
চলমান আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ধারার পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এসব ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আমানত কীভাবে সুরক্ষিত থাকবে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে জোরালো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। একীভূত হওয়ার পথে থাকা ব্যাংকগুলো হলো- ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এসব ব্যাংকের ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি যা ব্যাংকগুলোকে কার্যত দেউলিয়া করে দিয়েছে।
ব্যাংক একীভূতকরণএই পরিস্থিতিতে যখন ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী, এসব ব্যাংকে ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মিলে মোট ৪৫ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেন, যার মোট মূল্য প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর যদিও এর আগে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘এই রূপান্তরের সময় আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ থাকবে। উদ্যোক্তা পরিচালকরা ব্যাংকিং খাতকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, তাদের জন্য কোনো সহানুভূতি নেই।
আগামী মাস থেকেই এই একীভূত প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রথমে একটি ‘ব্রিজ ব্যাংক’ গঠন করা হবে, যা অস্থায়ীভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত হবে এবং এই ব্যাংকের মাধ্যমে একীভূত ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম চলমান থাকবে। একপর্যায়ে এই ব্যাংকটির শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে প্রায় তিন বছর।
যে কোনো আইনি জটিলতা এড়াতে সরকার সম্প্রতি ‘ব্যাংক রেজ্যুলেশন অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংক একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণে বিশাল ক্ষমতা দিয়েছে।
ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক অবস্থা মূল্যায়নের জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়াং এবং কেপিএমজিকে নিয়োগ দেয়, যার অর্থায়ন করছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এই অডিটের লক্ষ্য হলো- খাতটিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। চারটি ব্যাংক গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল, আর এক্সিম ব্যাংক পরিচালনায় ছিলেন নাসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম মজুমদার। অভিযোগ রয়েছে, তারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের নীতিমালা পরিবর্তন করে নিজেদের স্বার্থে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছেন এসব ব্যাংক থেকে।
ব্যাংক একীভূতকরণের এই উদ্যোগ দেশের আর্থিক খাত পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও বিনিয়োগকারীদের সম্পদ রক্ষা এবং আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি বলে মনে করছেন গ্রাহকরা।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় আশ্বাস : বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘এই মুহূর্তে একীভূতকরণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে এগোবে, তা পুরোপুরি বলা সম্ভব নয়। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারী, ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের স্বার্থ পুরোপুরি সুরক্ষিত থাকবে। এখানে কোনো চমক বা অস্বাভাবিকতা থাকবে না। কারা ক্ষতির জন্য দায়ী, সেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। ব্যাংকগুলোর করপোরেট সুশাসনের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। একীভূতকরণ পরিকল্পনা আইনি ও আর্থিক দিক থেকে যথাযথভাবে করা হচ্ছে। ’ প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘প্রায় সব ব্যাংকই নেতিবাচক ইকুইটিতে রয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৬ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। যদি সরকার এই ঘাটতি পূরণ না করে, তাহলে বিনিয়োগকারীদের মূলধন ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ সরকারের তহবিল ছাড়া ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। মূলত আমানতকারীদের অর্থ ফেরত নিশ্চিত করতেই সরকার এগোচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের জন্য রিটার্নের আশা এখন অনেক বাস্তবতাবর্জিত হয়ে পড়েছে। ’ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আবুল কালাম বলেন, ‘একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় আমরা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সজাগ থাকব। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা আমাদের দায়িত্ব। আমরা নিশ্চিত করব, প্রতিটি ধাপে কী হচ্ছে, তার স্বচ্ছতা যাতে বজায় থাকে এবং বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি না হয়। ’ ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া যতটা জটিল, ততটাই প্রয়োজনীয় দেশের আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর আশ্বাস কিছুটা হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে আস্থা ফিরবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন