
অনলাইন ডেস্কঃ
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে আজ দুপুর ১২টার দিকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে আনা হয়। পরে তাঁকে রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়। বেলা দুইটার দিকে মাথায় হেলমেট পরিয়ে তাঁকে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের এজলাস কক্ষে নেওয়া হয়।
তখন অন্য মামলার শুনানি গ্রহণ করছিলেন আদালত। একটি বেঞ্চে বসে ছিলেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ। প্রায় ৫০ মিনিট তিনি বেঞ্চেই চুপচাপ বসে ছিলেন।
বেলা ২টা ৫২ মিনিটে অধ্যাপক কলিমুল্লাহর মামলার শুনানি শুরু হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে কলিমুল্লাহকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলায় ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে শুরু করেন আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম। তিনি বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলার ঘটনার সঙ্গে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কলিমুল্লাহ জড়িত রয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ–বাণিজ্য করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।’
দুদকের পিপি যখন অধ্যাপক কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসংক্রান্ত তথ্য আদালতের কাছে তুলে ধরতে থাকেন, তখন কলিমুল্লাহ মাথা নিচু করে তাঁর বক্তব্য শুনতে থাকেন।
পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, ‘মাননীয় আদালত, অধ্যাপক কলিমুল্লাহ নজিরবিহীন দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নকশা বদল করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারকে আইনবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ঋণ দেওয়া হয়।’
দুদকের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, অধ্যাপক কলিমুল্লাহ রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যালয়ে অফিস না করে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ অফিসে বসতেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি সরকারি ক্রয় চুক্তি মানেননি। তিনি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছেন।
যা বললেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ
আদালতে অধ্যাপক কলিমুল্লাহর পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। দুদকের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর আদালত অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করার অনুমতি দেন। তখন তিনি বলেন, ‘দুদকের পক্ষ থেকে যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেই সমস্যার শুরুটা করেছিলেন আগের উপাচার্য। তিনি হল নির্মাণের ভিত্তি করে গিয়েছিলেন। আমি শুধু সেটি কন্টিনিউ করেছি। সেখানে আমার আর কোনো কিছু করার ছিল না।’
আদালতের উদ্দেশে অধ্যাপক কলিমুল্লাহ বলেন, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে তিনি মামলার শিকার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির বিরুদ্ধে তিনি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেই সময় শিক্ষাব্যবস্থায় অরাজক পরিস্থিতি ছিল।
গত বছর আন্দোলনের সময় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যা করার পর এর প্রতিবাদ করেছিলেন বলে আদালতে উল্লেখ করেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের উপাচার্যের আমলে সেখানে ব্যাপক নিয়োগ–বাণিজ্য হয়েছিল। পরে তাঁকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়।’
তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি তদবির করতেন বলে আদালতের কাছে অভিযোগ করেন অধ্যাপক কলিমুল্লাহ। তিনি বলেন, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ–বাণিজ্য হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি যখন দায়িত্ব পালন করেন, তাঁর বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল।
অধ্যাপক কলিমুল্লাহ আদালতের কাছে নিজেকে নিরপরাধ দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নই। ছাত্রজীবনেও আমি কোনো রাজনীতি করিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না।’
অধ্যাপক কলিমুল্লাহ যখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিতে থাকেন, তখন আদালত তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেন। আদালত অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ হয়েছেন, আপনি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। আপনার উচিত ছিল, দায়িত্ব থেকে সরে আসা। আমি শিক্ষকদের সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি।’
প্রায় ৩৫ মিনিট দুদকের আইনজীবী ও অধ্যাপক কলিমুল্লাহর বক্তব্য শুনে আদালত তাঁকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেন। এই আদেশ শোনার পর অধ্যাপক কলিমুল্লাহ বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তখনো তিনি নিজের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে থাকেন। আদালত দুদককে সতর্কতার সঙ্গে অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেন।
রিমান্ড আদেশের পর অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে আদালত কক্ষ থেকে আবার নিয়ে আসা হয় হাজতখানায়। এবার তাঁকে সেখানে ১০ মিনিট রাখা হয়। পরে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁকে হাজতখানা থেকে বের করে আদালতের সামনে রাখা প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। প্রিজন ভ্যানে তোলার পর অধ্যাপক কলিমুল্লাহ বলতে থাকেন, ‘আমি দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। দুদক যেন নখ দন্তবিহীন ব্যাঘ্র হিসেবে কাজ না করে।’
বিকেল পৌনে চারটার দিকে অধ্যাপক কলিমুল্লাহকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে রওনা হয়। এ সময় তাঁকে প্রিজন ভ্যানের বেঞ্চে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়।
৬ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত জুন মাসে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয়।