
এক কালের সাহসী সাংবাদিক, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় অধ্যাপক, লেখক, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং বর্তমানে সরকারের আইন মন্ত্রী বা উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, দুনিয়াতে ভালো লোকের চেয়ে খারাপ লোক বেশি এবং তারা সংগঠিত। ভালো লোকেরা খারাপ লোকদের দ্বারা বিভ্রান্ত। শেখ হাসিনার আমলে তিনি অত্যাচারিত ছিলেন, তার বুকের ভেতরে ক্রন্দন ছিলো কিন্তু মানুষ যে এত জটিল- এটা তিনি তখন বোঝেন নাই, গত এক বছর সরকারের ভেতরে থেকে এখন তিনি তা বুঝেছেন। (ধারণা করি তিনি কিছুটা হলেও শেখ হাসিনার জুতা পায়ে দিয়ে এই অনুভূতি অর্জন করেছেন এবং নিন্দুকেরা এজন্য তার এই বক্তব্যকে “আগেই ভালো ছিলাম ২.০” শিরোনামে কুৎসা রটাচ্ছে।
মাঝে মাঝে এই ভদ্রলোকের জন্য আমার মায়া হয়, (করুণা বলতে চাই না) ১৯৯২ সালে একাত্তরের ঘাতক ও রাজাকারদের বিচারের জন্য শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত গণ আদালতের সময় থেকে তাকে কমবেশি চিনি। তিনিও গণ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন ছিলেন। কিন্তু একটা মানুষ কিভাবে ধিরে ধিরে বদলে যায় এবং বিবেক বিসর্জন দেয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ ড. আসিফ নজরুল।
আসিফ নজরুল সাহেব, দুনিয়া অনেক বড, দুনিয়ার কথা থাক। কোনো দেশের বা সমাজের বেশিরভাগ মানুষ খারাপ হয় না, হতে পারে না। আমার ধারণা, সেটা আপনি নিজেও জানেন এবং বোঝেন। খারাপ হয় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। কিন্তু সরকার এবং রাষ্ট্র যখন সেই মুষ্টিমেয় খারাপ মানুষদের অন্যায় কাজে বাধা না দিয়ে তাদেরকে আস্কারা দেয়, তখন তারা নিজেদেরকে অসীম ক্ষমতাধর মনে করতে শুরু করে। তখন তাদের খারাপ কাজের মাত্রাও বহুগুণ বেড়ে যায়। গত এক বছর ধরে আপনাদের সরকার সেই কাজটাই করে যাচ্ছে বলে আজ আপনার এই উপলব্ধি। নিজের ব্যর্থতা স্বীকারের সংস্কৃতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেই, আপনিও তার ব্যতিক্রম নন। সেজন্য অল্পকিছু অপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী এবং দুস্কৃতকারীর অপকর্মের দায় আপনি পুরো মানব জাতির ওপর চালিয়ে দিলেন!
খারাপ লোকেরা সংগঠিত, আপনার এই কথা সত্যি। কিন্তু এখন তো শেখ হাসিনার “ফ্যাসিস্ট” সরকার নেই, আপনাদের মহৎ সরকার কেন খারাপ লোকদের সংগঠিত হতে দিচ্ছে? দেখতে পাচ্ছি তারা প্রকাশ্যেই সংগঠিত হচ্ছে। তারা যদি গোপনেও সংগঠিত হতো, আপনার হাতে আইন- আদালত আছে, পুলিশ- সেনাবাহিনী আছে, গোয়েন্দা সংস্থা আছে, তাহলে কি করে খারাপ লোকেরা সংগঠিত হয়?
ভালো আর খারাপ লোকের মাঝে আরেকটা শ্রেণী আছে, যাদের কথা আপনি বলেননি। সেটা হলো নীরব জনগোষ্ঠী। আমি মনে করি দেশের ৯০ শতাংশ মানুষই এই নীরব গোষ্ঠীভুক্ত, তারা সবই দেখে, সবই বোঝে কিন্তু তাদের কিছু করার নেই, কিছু বলার নেই। দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত তারা নীরব থাকে, পিঠ ঠেকে গেলে তারা রুখে দাঁড়ায়। আর বাকি ১০ শতাংশের মধ্যে ১ শতাংশ হয়ত আসলেই খারাপ, অপরাধী বা ষড়যন্ত্রকারী। তাদের ভয়ে অবশিষ্ট ৯ শতাংশ লোক কথা বলতে পারে না। কথা বলতে গেলে একদিকে তারা সংগঠিত খারাপ লোকদের আক্রমণের শিকার হন অন্যদিকে, তাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে জেলে পাঠায় সরকার। এই বাস্তবতায় দৃশ্যমান থাকে শুধু খারাপ লোকেরা, যাদেরকে আপনি দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ বলে আখ্যা দিলেন।
গত বছরের জুলাই আগস্টে এত রক্ত এত প্রাণের বিনিময়ে আপনারা যে সরকারে বসলেন, সেখানে আপনাদের দায়িত্ব কি ছিলো? আপনারা বারবার বলেছেন, শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের অপরাধিদের বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার এবং নির্বাচন- এই তিনটা কাজ করবেন, খুব ভালো কথা। করেন, কিন্তু একটা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব কি? আপনি আইনের ছাত্র এবং শিক্ষক, আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন যে, কোনো সরকারের প্রথম কাজ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আইন শৃংখলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং মানুষের বিচার পাবার অধিকার সমুন্নত করা। পরবর্তী দায়িত্ব নাগরিকদের চলাফেরা, সভা সমাবেশ, কথা বলা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কৃষি, পরিবেশ, শিল্প সংস্কৃতি- সেসব কথা নাই বা তুললাম। কিন্তু নাগরিকদের সেই নিরাপত্তার দায়িত্ব, বুকে হাত দিয়ে বলুন, আপনারা গত এক বছর নিশ্চিত করতে পেরেছেন? প্রাথমিক দায়িত্ব পালনেই যেখানে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন, পরবর্তী দায়িত্ব পালনে আপনারা কতটা সফল হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়! শুধু আমার না, আপনাদের নিয়োগ কর্তা ছাত্ররাও নিত্য সেই সন্দেহ জানান দিয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় আপনার হতাশা প্রকাশ পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের হতাশা আর ব্যর্থতার ভার দয়া করে দেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপাবেন না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট জ ই মামুনের নিজের ফেসবুক ওয়াল থেকে নেয়া।
বিশেষ দ্রষ্টব্য- লেখকের এই লেখা ও মতামত একান্তই তার নিজস্ব। এই লেখার সাথে অন লাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময় নিউজ ডটকমের পলিসির কোন সম্পর্ক নেই।