
অনলাইন ডেস্কঃ
চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা। পোশাক বা কোনো অজুহাতে নারী হেনস্তা। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে লাশ পোড়ানো। মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার নৈরাজ্যে মানুষ মরছে অহরহ। জনমনে প্রশ্ন, তাহলে কি মবের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ৫ আগস্টের এতদিন পরেও মব ভায়োলেন্সের লাগাম টানতে ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অন্তর্বর্তী সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বারবার কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন নেই। বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, প্রশাসন ও পুলিশের উদাসীনতায় এসব অপরাধ থামছেই না। মবের মাধ্যমে সমাজে ভয় চালু করা হচ্ছে। ভয়াবহ মব সহিংসতায় নানা সন্দেহে নির্বিচারে মানুষ মারছে অহরহ।
বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, মব ঠেকানো যাচ্ছে না, নাকি ঠেকানো হচ্ছে না। তারা বলছেন, মব তৈরি করে সমাজে ভয় চালু করা হচ্ছে। কারণ পুলিশের সামনেই কিংবা অনেক সময় পুলিশের বিরুদ্ধেই মবরে অভিযোগ। পুলিশের নীরব ভূমিকা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। প্রশ্ন – পুলিশ নীরব থাকলে মবের ঘটনাগুলো আসলে ঠেকাবে কে?
ভোলায় নারীকে চুল কেটে জুতার মালা পরানো, নুরাল পাগলার লাশ পোড়ানো, চুরির অপবাদ দিয়ে রংপুরে ভ্যান চালককে পিটিয়ে হত্যা। এমনকি একাত্তর ও সংবিধান নিয়ে আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে হয়রানি। একের পর মবের ঘটনায় সরকারসহ সব পক্ষ বারবার কাগুজে বিবৃতি আর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থামছে না মব।
মতের অমিল, রাজনৈতিক বিরোধ কিংবা ছোটখাটো ইস্যুতেও তৈরি হচ্ছে মব। মব-সন্ত্রাসে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ খোদ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত এক বছরের হিসাবে আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ১৯৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে মব সৃষ্টি করে। এ সময়ে শুধু ঢাকা বিভাগেই এধরণের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯২ জন।
গেলো এক বছরে সব মিলিয়ে ৬৩৭ জন বিক্ষিপ্তভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রোশের শিকার হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) চলতি বছরের ৮ মাসের মব সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান বলছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মব সন্ত্রাসে মানুষের মৃত্যু।
অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, সাধারণত মব হলো আইনের বাইরে গিয়ে, বিচার বহির্ভূতভাবে কাউকে হেনস্তা করা বা আক্রমণ করা, কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাউকে ভয় দেখানো। সেখানে কতজন ছিলো সেটি গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো এর উদ্দেশ্য, সেটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত একটা অস্ত্র। সরকার এবং বিভিন্ন ফোরাম থেকে মবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও এখনও মব থামছে না। মবের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশের নীরব ভূমিকায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। আর এসব ঘটনা ঠেকাতে পুলিশ নীরব থাকলে পরিত্রাণ কোথায়-এমন প্রশ্নও উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের এ অধ্যাপক আরও বলেন, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা আর পুলিশের উদাসীনতায় মবের ঘটনা বেড়েই চলেছে।
নাগরিক কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, মব সন্ত্রাস কয়েক ধরনের । কোনো প্রতিষ্ঠান দখল করতে হলে মব তৈরি করা হয়, তেমনি কাউকে ট্যাগ দিতে হবে বা কোনো পদ দখল করতে হবে তখনও মব সৃষ্ট করা হচ্ছে। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কারা দেশে মব সন্ত্রাস করছে? প্রশ্ন আনু মুহাম্মদের।
তিনি আরও বলেন, কারা ভাস্কর্য, ম্যুরালসহ বিভিন্ন শিল্পকর্ম ভাঙছে; পার্ক, মাজার, দরবারে হামলা করছে; কারা পূর্বঘোষিত আলোচনা সভায় হামলা করে মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিকদের জখম করছে; কারা নূরের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে রক্তাক্ত করেছে; কারা দখল চাঁদাবাজি করছে; কারা ক্রমাগত হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে; কারা জাতিগত-লিঙ্গ-ধর্মীয় বৈষম্য নিপীড়নের ঘটনা ঘটাচ্ছে; কারা সহিংসতা-মব সন্ত্রাসের উসকানি দিচ্ছে, কারা বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর জবরদখল নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে? গত সরকারের মত এই সরকারও গত কিছুদিন ধরে ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দ দুটি ব্যবহার করছে মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। ফলাফল দেখা যাচ্ছে একই। সরকার কি আরও নৈরাজ্যের পথে দেশকে ঠেলে দিতে চায়?’
দেশে এখন ‘মবের মুল্লুক’ চলছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান। মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, মব সৃষ্টি করে সমাজে ভয় চালু করা হচ্ছে। কেই স্বাধীনভাবে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে যদি দোসর ট্যাগ দেয়া হয়। মব তৈরি করে যাকে তাকে হয়রানি করাসহ মেরে ফেলা হচ্ছে। সরকার যা-ই বলুক না কেন, তারা মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না।
আর টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করে, সরকার প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ কোনোটিই ঠিকমতো করতে পারেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সক্রিয়, এ প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই শুধু দায়সারা বিবৃতি দিয়ে নয়, যে কোনো পরিস্থিতি আইনসিদ্ধভাবে মোকাবিলায় সরকারকে দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সুনির্দিষ্ট অপরাধে শাস্তি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা নতুন বাংলাদেশের প্রাধান্য। তবে এ জন্য প্রতিশোধ প্রবণ ও আত্মঘাতী মব জাস্টিস নয়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের পথ অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।
সরকারের দুর্বলতা, প্রশাসন ও পুলিশের শৈথিল্য মব সন্ত্রাসকে আজ মহামারির রূপ দিয়েছে। মব বা এই নৈরাজ্য কোথায় শেষ হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।