
অনলাইন ডেস্কঃ
শাহাদাত, ঢাকার আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ বছর প্রাথমিকে বৃত্তি চালু হলে পরীক্ষায় বসবে পঞ্চম শ্রেণির এই মেধাবী ছাত্র। সম্প্রতি তার স্কুলে গেছে শাহাদাতের চোখেমুখে স্পষ্ট দেখা যায় লক্ষ্যভেদের সেই প্রত্যাশা।
শাহাদাতের মতো একই প্রত্যাশা তার আরও অনেক সহপাঠীর। তার মধ্যে কারও কারও ইউনিফর্ম আর স্কুলের জুতা কেনা হয় না বহুদিন! কারণ, দারিদ্র্য আর শিক্ষাঙ্গণে যথেষ্ট আর্থিক অনুদান না পাওয়া।
তাই বৃত্তি পরীক্ষা হবে শুনে সবার মাঝে উচ্ছ্বাস। এবার যদি মেধা পায় যথার্থ মূল্যায়ন! কেউ কেউ বলেই ফেললো, বৃত্তি পেলে শার্ট-জুতা কেনার কথা।
বৃত্তি পাবেই, এমন আত্মবিশ্বাসে কেউ কেউ বাবার ঋণ পরিশোধের দায়িত্বটাও কোমল কাঁধে নেয়ার কথা বললো।
তবে এসব শিক্ষার্থীরা জানে না, চলমান নীতিমালা অনুযায়ী, ট্যালেন্টপুলে বৃত্তির পরিমাণ মাসে মাত্র ৩০০ টাকা। আর সাধারণ বৃত্তিপ্রাপ্তরা পাবে ২২৫ টাকা।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেছেন, ম্যাপিং করে কার কতটুকু প্রয়োজন সেই অনুযায়ী আর্থিক বরাদ্দ দেয়াটাই বেশি যৌক্তিক। আলাদা করে দেশব্যাপী একটা পরীক্ষা নিয়ে বৃত্তি দিয়ে বাচ্চাদের মধ্যে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখানো হলো, সে ভালো, সে বৃত্তি পেয়েছে।
আবার অনেকের ধারণা, আর্থিক অনুদান কম থাকার পরও বৃত্তি পরীক্ষা চালুর ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, স্কুল শিক্ষক আর কোচিং সেন্টার বেশ আগ্রহী।
আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারহানা বেগম ভিন্নমত পোষণ করলেন। তিনি বলেছেন, বৃত্তি হলেই কোচিং সেন্টার বাড়বে সেটা তো আসল বিষয় নয়, তারপরও যদি হয়, সরকার সেক্ষেত্রে একটা উদ্যোগ নেবে, আইন করবে, কোচিং সেন্টার যেন এ ধরনের প্রচারণা কিংবা এ ধরনের বাণিজ্য করতে না পারে। বাচ্চারা মেধারও স্বীকৃতি পাক এবং সেই সাথে একটু প্রণোদনা ওরা চায়।
নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মির্জা মাহমুদ প্রশ্ন তুললেন, আমাদের শিক্ষকদের যে বেতন দেয়া হয় সেটার জন্যই কি শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে না?
মূলত কয়েক দফায় শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তিত হওয়ায় বৃত্তি পরীক্ষার বিপক্ষে কেউ কেউ। তবে অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকায় নিম্ন আয়ের অভিভাবকরা আগ্রহী।
শিক্ষা গবেষকরা মনে করেন, পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি হতে হবে এমন, যেন কোচিংমুখী না হয় শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেছেন, আমার কাছে মনে হয় যে বৃত্তি পরীক্ষাটা থাকলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলাদা একটি গতি আসে। এখন আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি কেন এই বৃত্তি পরীক্ষাটা অতিরিক্ত চাপ হচ্ছে। হ্যাঁ, কোনও কোনও সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষক সারাদিন বসিয়ে রাখে, তাদেরকে অতিরিক্ত চাপ দেয়, সেই জায়গাগুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের অভিমত, সংকট থাকবেই। সেগুলো মোকাবেলা করেই বৃত্তি পরীক্ষা নিতে তারা প্রস্তুত। বাড়ানো হবে অনুদানের পরিমাণও।
তিনি বললেন, মাঠ পর্যায়ে এটার (বৃত্তি পরীক্ষা) বেশ চাহিদা আছে। আমাদের দেশীয় যে প্রেক্ষাপট, সামগ্রিকভাবে এই মুহূর্তে আমাদের মনে হয়েছে যে এটি আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবার মধ্যে এক ধরনের প্রণোদনা তৈরি করবে। কিন্তু যদি আদর্শ বলেন, আদর্শ অবস্থায় আমরা স্কুলগুলোকে নিয়ে যাই, তখন এই ধরনের আদাবৃত্তির প্রয়োজন হবে না।
২১ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বা কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। একে বৈষম্যমূলক বলছেন কেউ কেউ। তবে নীতি নির্ধারক বলছেন ভিন্ন কথা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান বলেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে বাচ্চারা পড়াশোনা করে অধিকাংশই প্রান্তিক পর্যায়ের। কিন্তু কিন্ডাগার্ডেন স্কুলে আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করে। কিন্ডারগার্ডেন স্কুলগুলোতে ক্লাস থ্রি থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তারা কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষা অব্যাহত রেখেছে। সেখানে আমাদের এই প্রান্তিক পর্যায়ের বাচ্চাদের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তাদেরকে লেখাপড়ার প্রতি আরও বেশি উৎসাহিত করার জন্যই এই বৃত্তি পরীক্ষা চালু করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর পরিবর্তে চালু করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি)। এ পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতেই শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেয়া হতো। চাপ কমাতে পরে বন্ধ হয় সেই পরীক্ষাও।
থানা কিংবা উপজেলা অনুসারে সর্বোচ্চ নম্বরধারীকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেয়া হয়। এছাড়া ইউনিয়ন, পৌরসভা ও ওয়ার্ডভিত্তিক সাধারণ বৃত্তি দেয়া হয়। তবে প্রতিটি স্কুল থেকে শতকরা ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারেন।