
অনলাইন ডেস্কঃ
‘জুলাই জাতীয় সনদ’ এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর সাংবিধানিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পক্ষে বিএনপি। দলটি মনে করে, জুলাই সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে ভবিষ্যতে বিতর্ক ও জটিলতা তৈরি হতে পারে। অবশ্য বিএনপি মনে করে, জুলাই সনদে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া সংস্কার প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো নির্বাচিত পরবর্তী সরকার গঠনের দুই বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
অন্যদিকে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির অভিমত হচ্ছে, এটার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হলে অতীতের আরও ঘটনা যেমন নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থান এবং ভবিষ্যতে এমন কোনো অভ্যুত্থান হলে সেটারও সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্ন আসবে। এতে জটিলতা বাড়তে পারে। কারণ, জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থান হলেও এটাতে নতুন করে দেশ স্বাধীন হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে জনগণের ওপর চেপে বসা স্বৈরশাসনের অবসান হয়েছে। তা ছাড়া একাত্তরের মহান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাহাত্তরে প্রণীত সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল না ২০১১ সাল পর্যন্ত। ওই বছর সপ্তম তপশিলে তা যুক্ত করা হয়, যা চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়েছে। তাই জুলাই ঘোষণাপত্রও আলাদা করে সংবিধানে যোগ করা অপ্রয়োজনীয়। এ অবস্থায় ‘রাজনৈতিক দলিল’ হিসেবে রাষ্ট্রের আর্কাইভে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র সংরক্ষণের পক্ষে বিএনপি।
সরকারের পাঠানো ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া এবং জুলাই ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে গত সোমবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এমন মতামত উঠে এসেছে বলে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা কালবেলাকে জানিয়েছেন। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানা গেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি আর আলোচনা করতে চায় না। তবে জুলাই সনদ নিয়ে তারা আলোচনা অব্যাহত রাখবে। কারণ, সংস্কারের ব্যাপারে তারা অত্যন্ত আন্তরিক।
সাত দফার জুলাই সনদের খসড়ার ৭ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব।’ ছয় নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ‘এই সনদ গৃহীত হওয়ার পর এতে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটি মনে করে, ঐকমত্য হওয়া সংস্কার প্রস্তাব বা সুপারিশগুলো সরকার গঠনের দুই বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব। বিএনপির স্থায়ী কমিটি ৭নং দফা তথা সনদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেও খসড়ার বাকি ছয় দফা অঙ্গীকারনামার সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।
গণঅভ্যুত্থানের পর গত বছরের ডিসেম্বর থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা দ্রুততম সময়ে ঘোষণাপত্র চাইলেও এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল বিএনপি। এ অবস্থায় অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করতে চেয়েছিলেন। এর আগের রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রনেতাদের ডেকে জানান, ঐক্যের স্বার্থে সরকার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলকে নিয়ে ঘোষণাপত্র তৈরি করবে।
এর অংশ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। বিএনপি প্রয়োজনীয় সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে মতামত দিয়ে তা সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই ইস্যুতে সরকারের কার্যক্রম ধীরগতিতে চলতে থাকে। একপর্যায়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ফের আন্দোলনে নামে। এর ফলে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়নে সরকারের কার্যক্রমে গতি আসে। এখন বিএনপিসহ কয়েকটি দলের কাছে পাঠিয়ে চূড়ান্ত খসড়ার ওপর মতামত নেওয়া হচ্ছে। আসছে আগস্ট মাসে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন করতে চায় সরকার।
জানা গেছে, প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে। ঘোষণাপত্রে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিএনপি, জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পরে বিএনপির মতামতে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’, ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সরকারের করা সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রে পুনঃপ্রবর্তনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এক-এগারোকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফল বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রথম খসড়ায় বলা হয়েছিল, অভ্যুত্থানের চেতনায় দেশ গড়তে সংবিধানকে বাতিল বা সংশোধন করা হবে। তবে চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, মানবিক ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখতে সংবিধান সংস্কার করা হবে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন, আওয়ামী লীগের গুম-খুন-দুর্নীতির বিচারের অঙ্গীকার রয়েছে। অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের স্বীকৃতি রয়েছে।
বিএনপি আগেই জানিয়েছিল, জুলাই ঘোষণাকে সংবিধানের চতুর্থ তপশিলে যুক্ত করতে চায় তারা। পুরো ঘোষণাপত্র নয়, অভ্যুত্থানের স্পিরিট ও স্বীকৃতি হিসেবে একটি অনুচ্ছেদ এবং ঘোষণাপত্রের উল্লেখ থাকবে।
জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। দলটি সেখানে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করাসহ ভাষাগত কিছু পরিবর্তন এনেছে। দু-একদিনের মধ্যে চূড়ান্তকৃত জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্র খসড়ার একটি কপি সরকারকে পৌঁছে দেবে বিএনপি।